Ads

সামাজিক রোমান্টিক প্রেমের গল্প "নাইওরি" @মিঃ মধু

গল্পঃ--- নাইওরি 

লেখিকাঃ- মৌরি মরিয়ম

পর্ব ১
সামাজিক রোমান্টিক প্রেমের গল্প  "নাইওরি"  ।  @মিঃ বুদ্ধিমান গাধা
কেশবপুর গ্রামের সর্বদক্ষিনে মির্জা বাড়ি। 
বাড়ির মালিক জয়নাল মির্জা উক্ত এলাকার জনপ্রিয় চেয়ারম্যান। প্রভাবশালী লোক। লোকে তাকে সম্মান করে, মেনে চলে, ভয়ও পায়। তার জনপ্রিয়তার কারণ সে অত্র এলাকার উন্নয়নের জন্য যেসকল কাজ করেছেন তা বিগত বৎসরগুলোতে অন্য কোনো চেয়ারম্যান করে যেতে পারেননি। এছাড়াও তিনি দিলদরিয়া মানুষ। লোকমুখে প্রচলিত আছে, জয়নাল মির্জার কাছে সাহায্যের হাত পেতে কেউ কোনোদিন ফিরে যায় নি। তা সে যে সাহায্যই হোক না কেন!
জয়নাল মির্জার বিভিন্নরকম ফসলের ক্ষেত আছে। সেসব ফসল বিক্রি বাবদ তার ভালো রকম আয় হয়। 
স্ত্রী কোহিনূর বানু, একমাত্র কন্যা জেসমিন, দুই পুত্র জালাল, জব্বার এবং দুই পুত্রবধূ আসমা ও মিনু কে নিয়ে তার সংসার।
আষাঢ় মাস, ১৯৭৪ সাল। আজ সন্ধ্যার পর জয়নাল মির্জার কাচারি ঘরে আসর বসেছে। এধরনের আসর প্রায়ই বসে। এই আসরে কোনোদিন চলে কলের গান, কোনোদিন চলে রেডিও। আজ রেডিওতে "মধুমালা মদন কুমার" নাটক সম্প্রচারিত হবে তাই লোকজনের আনাগোনা বেশি। কাচারি ঘরে সকলের জায়গা হচ্ছেনা। গাদাগাদি করে বসার পরেও অনেক লোক সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। সারাদিন ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হওয়ায় উঠানজুড়ে প্যাঁচপ্যাঁচে কাদা, নাহলে উঠানেও লোকজনের বসার ব্যবস্থা করা হতো।
এ নাটক যে আগে কেউ শোনেনি ব্যাপারখানা তা নয়। রেডিওতে একই নাটক বারবার সম্প্রচারিত হয়। একাধিক বার শোনার পরেও নাটক শোনার ব্যাপারে গ্রামবাসীর আগ্রহের শেষ নেই। এছাড়া যেদিন ভানুর কৌতুক শোনায় সেদিনও বেশ ভীড় হয়।
লম্বা কাচারি ঘরের এক দিকে একটা চৌকি পাতা। কোনো বহিরাগত অতিথি এলে এখানেই ঠাঁই হয়। 
ঘরের অন্য দিকে দুইপাশে লম্বা লম্বা দুটো বেঞ্চ পাতা। গ্রামের গণ্যমান্য লোকেরা এই বেঞ্চে বসেন। 
আর নিচু জাতের লোকেদের জায়গা হয় মাটিতে পাটির উপরে যাকে স্থানীয় ভাষায় হোগলা বলা হয়। চেয়ারম্যান সাহেবের বসার জন্য একখানা গদির ব্যবস্থা আছে বৈকি। তিনি সেখানেই বসেন। কাচারি ঘরে মহিলাদের আসা সম্পূর্ণ নিষেধ। কিন্তু চেয়ারম্যান সাহেবের ষোড়শী কন্যা জেসমিনের নাটক শোনার খুব শখ। 
তার খুব জানতে ইচ্ছে হয় নাটকে কী হয়? কেন এত মানুষ ছুটে আসে এই নাটক শুনতে? বছরখানেক ধরে সে তার বাপ-ভাইদের কাছে নাটক শোনার জন্য বায়না করে আসছে। অবশেষে এতদিনের বায়নার পর চেয়ারম্যান সাহেব কাচারি ঘরের পেছন দিকে একটা বারান্দা দিয়েছেন যাতে জেসমিনসহ অন্যান্য মহিলারাও নাটক শুনতে পারেন।
নাটক শেষে ধীরে ধীরে কাচারি ঘর খালি হতে লাগলো। জয়নাল মির্জার যখন উঠে যাচ্ছিলেন তখন তার ছোটপুত্র জব্বার মির্জা তাকে ইশারা করল বসার জন্য। সম্ভবত তার কিছু বলার আছে। তিনি বসলেন। 
ঘর খালি হলে জব্বার বড়ভাই জালালকে নিয়ে বাবার পাশে এসে বসল।
জয়নাল মির্জা বললেন, "বিষয় কী?"
জব্বার বলল, "আব্বা হারুন ব্যাপারীর বিষয়।"
জয়নাল মির্জা বিরক্ত হয়ে বললেন,
"এখন এইসব বলার সময় না। আমার ঘুমের সময় হইছে। এইসব বইলা মেজাজ খারাপ করবা না জব্বার।"
জয়নাল মির্জা ছেলেদেরকে আর কথা বাড়ানোর সুযোগ দিলেন না। তিনি খাবার ঘরের দিকে গেলেন। অন্যান্য দিন এতক্ষণে রাতের খাবার খেয়ে এক ঘুম হয়েও যায়। আজ নাটক শুনতে শুনতে দেরি হয়ে গেছে।
যেদিন সমুদ্র আমায় ইশারা করেছিল,
রৌদ্রময় দিনের স্তব্ধতায়…
এটুকু লিখে রঞ্জু পৃষ্ঠাটা ছিঁড়ে ফেলে দিল। কী লিখছে সে এসব? কিসের ইশারা! সমুদ্র কেন ইশারা করবে, ধুর! পৃষ্ঠা ছিড়তে ছিড়তে ডায়েরির অর্ধেক খালি হয়ে গেছে। ডায়েরির এমন বেহাল দশা দেখে আপাতত কবিতা লেখা বাদ দিল সে। বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও ছোটবেলা থেকেই তার বেশ সাহিত্যপ্রেম রয়েছে। মাঝেমাঝে কবিতা লেখে। কবিতা লিখলে তার বেশ একটা সুখ সুখ অনুভূতি হয়। কিন্তু ইদানীং শত চেষ্টা করেও ভালো কিছু লিখতে পারছে না। যা লিখছে সেটা তার নিজের-ই পছন্দ হচ্ছে না। কাঠের দোতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় তার শোবার ঘর। সেই ঘরের সামনে খোলা বারান্দা। বারান্দার এক পাশে সে এখন পা ছড়িয়ে বসে আছে। দৃষ্টির সীমানায় সূর্যমনি গ্রাম, এই বাড়ি, বাড়ির উঠোন, উঠোন পেরিয়ে পুকুর। বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে সরু খাল। খালের পাশে পানের বর। বাড়িতে ঢোকার পথে সারি সারি সুপারি গাছ। 
পিছনে মেহগনি বাগান। রান্নাঘরের পাশে ঝিঙে কাঁকরোলের মাচায় ফুল ধরেছে। বৃষ্টিতে ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ বাতাস বয়ে নিয়ে আসছে এই বারান্দাতে। এই সবকিছুই তার নিজের। কিন্তু এসব কিছুই তার ভালো লাগে না। তার মন পড়ে রয়েছে মহসিন হলের ২০৭ নম্বর ঘরে, রেসকোর্স ময়দানে, শহিদ মিনারে, মধুর ক্যান্টিনে এবং পাবলিক লাইব্রেরির বইয়ের ভাঁজে ভাঁজে।
মাসকয়েক হলো সূর্যমনি এসেছে রঞ্জু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে পড়ে সে। মহসিন হলে থাকে। কিছুদিন আগে তার হলেরই চার ছাত্র আকস্মিকভাবে খুন হয়। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। খবর পেয়ে তার বাবা গ্রামে ফিরে আসার আদেশ করেন। রঞ্জুও আদেশমত গ্রামে চলে আসে। পড়াশোনার বাইরে অন্য কোনো কিছুতে সে নিজেও জড়াতে চায় না। তার কয়েকদিন পরেই ইউনিভার্সিটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে। কবে সব স্বাভাবিক হবে, কবে সে ফিরে যাবে তার প্রিয় শহরে সেই অপেক্ষায় প্রতিটি প্রহর গুনছে।




পর্ব ২
সামাজিক রোমান্টিক প্রেমের গল্প  "নাইওরি"  ।  @মিঃ বুদ্ধিমান গাধা
আষাঢ় মাস। ভরা বর্ষায় টলমল জলে ভরে উঠেছে পুকুর। ঝরে পড়া অজস্র সোনালু ফুল পুকুরের জলে ভাসছে। জেসমিন সেই পুকুরের শান বাঁধানো ঘাটলায় বসে ভাতিজা, ভাইঝিদের সাথে নিয়ে আধাপাকা আমের ভর্তা বানাচ্ছে। ভর্তা আবার দুই পদে বানানো হচ্ছে। বাচ্চাদের জন্য ঝাল ছাড়া, বড়দের জন্য ঝাল দিয়ে।
আউশ ধান উঠেছে। মির্জা বাড়ির বউরা সকাল থেকে বড় বড় পাতিলে সেই ধান সেদ্ধ করছে। চুলার পাশে বড় হোগলা বিছানো। পাতিলের ধান প্রথমে সেই হোগলায় ঢেলে ফেলা হয়। বাড়তি পানিটুকু ঝড়ে গেলে সেই ধান ডালা ভরে নিয়ে উঠানে অন্য শুকনো হোগলার উপর ঢালা হয়। আমন ধানের সময় অবশ্য সরাসরি উঠানেই ধান শুকানো হয়। প্রথমে উঠানটা গোবর দিয়ে লেপে নেয়া হয়, এতে মাটি শক্ত হয়, ধান উঠানোর সময় আলগা মাটি উঠে আসেনা। 
কিন্তু আউশ ধানের সময় হুটহাট বৃষ্টি নেমে পড়ে বলে হোগলার উপর শুকানো হয় যাতে বৃষ্টি নামলে দ্রুত তুলে ফেলা যায়। কোহিনূর বানু বড় বউ আসমাকে নিয়ে ধান সেদ্ধ করছেন। আসমা ভূতের মত কাজ করতে পারে। জনশ্রুতি আছে, কেশবপুরের এতবড় পালের দিঘি নাকি এক রাতে কেটেছিল ভূতেরা। সেই দিঘি কাটার গল্প একেকজনের মুখে একেক রকম। আসমা তেমনি এক দিনে মনকে মন ধান সেদ্ধ করে ফেলতে পারে। আসমা সাথে থাকলে তার তেমন বিশেষ কোনো কষ্ট হয় না।
একজন কাজের মহিলা ডালা ভরে ধান উঠানে নিচ্ছে। ছোট বউ মিনু আরেকজন কাজের মহিলাকে নিয়ে সেই ধান আউলে দিচ্ছে। ইদানীং মিনুকে বেশি কষ্টের কাজ তিনি দিচ্ছেন না। কারণ তার ধারণা মিনু পোয়াতী হয়েছে। কিন্তু বান্দর মেয়েছেলে এত গুরুত্বপূর্ণ কথা তার কাছে কেন এখনো গোপন রেখেছে বুঝতে পারছে না!
যে পরিমাণ ধান সেদ্ধ করতে হবে তাতে এই ক'জন হিমশিম খাচ্ছে। আরও লোক দরকার কিন্তু আর কাউকে এই মুহূর্তে পাওয়া যাচ্ছেনা। এমতাবস্থায় জেসমিনের বাচ্চাদের সাথে বসে আম ভর্তা বানানোটা গুরুতর অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
কোহিনূর বানু এই গেরস্ত বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিলেন ৯ বছর বয়সে। তখনও সাবালক হননি। তার শাশুড়ি করিমন বিবির ছিল মাথার ব্যামো। এই ব্যামো শুধুশুধু হয়নি। এর পেছনে আছে বিরাট ইতিহাস। করিমন বিবি প্রায়ই স্বপ্নে দেখতেন, সাতটি মটকা ভরা কাচা টাকা। ঢাকনাগুলো ওঠে নামে। ভেতরে টাকা দেখা যায়। একটা গায়েবি আওয়াজ বলে, "এই সব টাকা তোর।"
করিমন বিবি যক্ষের ধনের কথা শুনেছেন তবে তার সাথে এমন কিছু হবে বিশ্বাস করতে পারতেন না।
এরপর একদিন সেই গায়েবি আওয়াজ তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। তাকে বলল, "ওঠ করিমন, দেখ তোর উগুইরতলার (চাল ডালের মটকা মাটিতে রাখলে নষ্ট হয়ে যায়, সেসব রাখার জন্য কাঠের তৈরি উঁচু তাকের মত জিনিস) নিচে সাতটা মটকা ভরা টাকা। সব তোর। আওলা মাটি(পুকুরে পানির নিচের ভেজা মাটি) দিয়ে ঘরবাড়ি সারাবাড়ি লেপে গোসল করে আসবি। তারপর পানিতে একফোঁটা গোবর দিয়ে তাতে মটকা থেকে কিছু কাচা টাকা নিয়ে জ্বাল দিলেই সব টাকা তোর হয়ে যাবে। কেউ দেখার আগে সব কাজ শেষ করবি।"
করিমন বিবি বিছানা থেকে নেমে উগুইরতলায় মটকাগুলো দেখতে পেলেন। ঢাকনা তুলে দেখলেন সবগুলো মটকা ভরা কাচা টাকা। সে দ্রুত পুকুর থেকে আওলা মাটি তুলে ঘর লেপেপুছে পরিস্কার করলেন। এরপর গোসল করে এসে চুলা ধরালেন। এসবই দূর থেকে লক্ষ্য করলেন তার বড় জা জমিলা বিবি। তার বড় সন্দেহ হয়। এতরাতে করিমন কেন ঘর লেপে! সে বিষয়টা বোঝার জন্য এগিয়ে যায়। করিমন একটা হাড়িতে পানি ও একফোঁটা গোবর দিয়ে চুলায় বসালেন। ঘরে আসবেন টাকা নিতে তার আগেই জমিলা বিবি নাপাক শরীরে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,
"তোমাগো আগুন তাওয়াডা কই গো করিমন?"
আগেকার দিনে আগুন বড় সহজলভ্য ছিল না। সারারাত মাটির পাত্রে তুষের ভেতর জ্বলন্ত কয়লা দিয়ে এক বিশেষ পদ্ধতিতে আগুন সংরক্ষণ করা হত। সেই পাত্রের নাম ছিল আগুন তাওয়া। সেই আগুন তাওয়ার ছুঁতোয় যেইনা জমিলা বিবির নাপাক শরীরে ঘরে পা দিল অমনি টাকা ভরা সাতটা মটকা গড়গড়িয়ে নেমে গেল পানিতে। এরপর উধাও। সেই থেকেই যক্ষের ধনের শোকে করিমন বিবি পাগল। প্রবাদ আছে, যারে ধরে যক্ষা, তার নাই রক্ষা। করিমন বিবিরও রক্ষা হয় নি। তিনি এমন বদ্ধ পাগল ছিলেন যে তাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। গেরস্ত বাড়ির সকল কাজের সাথে পাগল শাশুড়ির সেবা, সবই কোহিনূর বানুকে বড় জায়ের সাথে ভাগে করতে হতো সেই ৯ বছর বয়স থেকে। জেসমিনটা যেরকম কামচোর হয়েছে যদি এরকম কোনো বাড়ি গিয়ে পড়ে কীভাবে সামলাবে কে জানে!
কোহিনূর বানু রান্নাঘর থেকেই হাঁক ছাড়লেন, "ও লো নবাবের বেডি, আর কত গায়ে বাতাস লাগাইয়া চলবি? আসমার লগে একটু ধানের পাতিলডা ধরলেও তো পারোস।"
জেসমিন পুকুরপাড় থেকেই বলল, "অতবড় পাতিল আমি জাগাইতে পারি?"
"পারবি না ক্যা? ভাত খাও না তুই? পরের বাড়ি যাইয়া কেমনে করবি?"
"যহন পরের বাড়ি যামু তখন ঠিকই পারমু। দুই চক্কু দিয়া তো দেখতেইয়াছি কোন কাম ক্যামনে করে।"
কোহিনূর বানু বললেন, "এত বড় বড় বয়ান না দিয়া মিনুর লগে ধান আউলা গিয়া। পাতিল জাগাইতে পারবি না বুঝলাম। ধান আউলাইতে তো পারবি। হেইডা কইরা আমারে উদ্ধার করো।"
"না, ধানও আউলাইতে পারমু না। বাপের বাড়ি বইয়াও কাম করমু, পরের বাড়ি যাইয়াও কাম করমু। সারাজনম কি কাম কইরা কাটামু? ও ছোট ভাবি, তুমি কও দেহি বাপের বাড়ি থাকতে কি তুমি কোনো কাম করতা?"
মিনু হাসলো শুধু, কিছু বলল না। কোহিনূর বানু জানতেন এ মেয়ের সাথে কথা বলে লাভ নেই। তবুও বলার কাজ বললেন। বউরা বলতে তো পারবে না যে তিনি মেয়েকে কাজ করতে না বলে শুধু বউদের দিয়েই কাজ করান!
আমভর্তা বানানো শেষ হলে কলাপাতায় করে সেই ভর্তা বাড়ির সকলের কাছে পৌঁছানো হলো। সবাইকে দিয়ে তারপর জেসমিন খাওয়া শুরু করলো। আম কুচি কুচি করে কেটে তাতে লবন, মরিচ পোড়া, সরিষাবাটা আর লেবুপাতা দিয়ে মেখেছে। এ যেন অমৃত!
বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। আশেপাশে সবাই সব কাজ ফেলে ধান তুলতে দৌড়ে এলো শুধুমাত্র জেসমিন ছাড়া। বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিল রঞ্জু ও তার বন্ধু মানিক। এ বাড়ির ধান ভিজে যাচ্ছে বলে তারা দৌড়ে এসে ধানের হোগলা তুলতে লাগলো।
এবার কোহিনূর বানু রীতিমতো রেগে গেলেন। চিৎকার করে বললেন, "নবাবের বেডি তোর ঠ্যাং যদি আমি আইজ না ভাঙছি! বিষ্টি নাইম্যা গেল। অন্য বাড়ির পোলারা আইয়া ধান উডায় তাও তুই ধরোনা? তোরে পয়দা করছিলাম ক্যা আমি?"
সর্বনাশ! অন্য বাড়ির ছেলেরা আবার কেন আসলো! তোরা পথ দিয়ে যাচ্ছিলি যা না বাবা। অযথা ঘরে আগুন লাগাতে কেন এলি? এসব ভাবতে ভাবতেই জেসমিন গিয়ে ধানের হোগলা ধরলো। রঞ্জু ধান ঘরে তুলতে তুলতে সামনে তাকাতেই দেখতে পেল, স্বর্গ থেকে নেমে আসা কোনো পরী তার হোগলার উল্টোপাশের দিকটা ধরলো। একটা ছাপাশাড়ি প্যাঁচ দিয়ে পরা। লম্বা চুলগুলো লাল ফিতেয় কলাবেনী করা। গায়ের রঙ দুধে আলতা, গালের রগগুলো পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। ঠোঁটে চোরা হাসি। পরী তার দিকে তাকালো না।
কেশবপুর গ্রাম থেকে বের হতে না হতেই ঝুমবৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। কাচা রাস্তা কাদামাটিতে মাখামাখি হয়ে আছে। হাঁটতে গিয়ে পা গেঁথে যাচ্ছে।
মানিক বলল, "ভুল অইয়া গেল রে ব্যাডা।"
রঞ্জু তখনো একটা ঘোরের মধ্যে। পরিটাকে সে কিছুতেই মাথা থেকে সরাতে পারছে না। ঘোরের মধ্যেই সে মানিকের কাছে জানতে চাইল, "কী ভুল?"
"বৃষ্টি থামা পর্যন্ত চেয়ারম্যানবাড়ি থাকা উচিত আছিল।"
রঞ্জু এবার আচমকা বলল, "ঠিক বলছিস। আরও কিছুক্ষণ থাকা উচিত ছিল। পরিটারে আরও দেখতে পারতাম তাহলে।"
"এ রঞ্জু তোর কী অইছে? পরি কই পাইলি? হাবিজাবি কী কস?"
"যে মেয়েটা আমার সাথে ধানের হোগলা ধরল তার কথা বলি। পরির মত সুন্দর। কালকে আবার আসব ওকে দেখতে।"
মানিক এবার আঁৎকে উঠলো, "সর্বনাশ। এইসব চিন্তা একদম বাদ দিয়া দে। জেসমিন কার মাইয়া জানোস?"
"বাহ ওর নাম জেসমিন! কামিনী ফুল!"
"রঞ্জু জেসমিন চেয়ারম্যানের মাইয়া। জানতে পারলে খুন করব তোরে।"
"রাখে আল্লাহ মারে কে?"
এ কথা বলে হেসে ফেলল রঞ্জু।




পর্ব ৩
সামাজিক রোমান্টিক প্রেমের গল্প  "নাইওরি"  ।  @মিঃ বুদ্ধিমান গাধা
হুক্কা সাজানো হচ্ছে। কাজটি করছে কুদ্দুস। সে মির্জা বাড়ির কামলা। বয়স ত্রিশের ঘরে। সব রকম কাজই সে করে। তবে প্রতিদিন সন্ধ্যায় তার প্রধান কাজ হচ্ছে চেয়ারম্যান সাহেবের জন্য হুক্কা সাজানো। কিছুক্ষণ আগেই হুক্কার পানি বদল করে এনেছে সে। খেজুরের রস নষ্ট হয়ে গেলে সেই রস পুড়িয়ে চিটা গুড় বানানো হয়। এই গুড় হুক্কার তামাক মাখার কাজে ব্যবহৃত হয়। তামাক পাতা কুচি করে কেটে চিটা গুড় দিয়ে বিশেষ কায়দায় মাখাতে হয়। এই কাজটায় খুব দক্ষ কুদ্দুস। অন্যকারো হুক্কা সাজানো পছন্দ হয় না চেয়ারম্যান সাহেবের। তামাক পাতা মাখানো হয়ে গেলে তা হুক্কার কলকিতে দিল কুদ্দুস। তার উপরে জলন্ত কয়লা। অমনি হুক্কা প্রস্তুত। চেয়ারম্যান সাহেবের হাতে হুক্কার নল ধরিয়ে দিয়ে কাচারিঘর থেকে বের হয়ে গেল সে। কাচারিঘরে চেয়ারম্যান সাহেব ছেলেদের নিয়ে বসলে সেখানে অন্য কারো থাকার নিয়ম নেই।
জালাল জব্বার দুই ভাই জয়নাল মির্জার সামনে বসে আছে। তিনি হুক্কায় টান দিয়ে ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
"কও কী তোমাগো জরুরি কথা?"
"আব্বা হারুন ব্যাপারীর ভাবসাব ভালো না।"
"ব্যাপারীরে লইয়া এত ঘামাইস না জব্বার। তোরে আগেও মানা করছি।"
জালাল বলল, "জব্বারের মাথাডা গেছে আব্বা। অরে আমি কইসি যে বিষয়টা আব্বা আমাগো চেয়ে ভালো বোঝে।"
জব্বার বলল, "আব্বা আমার কথাখান শোনেন। আইজ একখান খারাপ খবর আছে।"
"কী খবর?"
"কালিশুরির জমির দলিল লইয়া হারুন ব্যাপারী টাউনের এক উকিলের কাছে গেছিল।"
"যাউক। তার কি টাউনে যাওনের আগে তোমার অনুমতি নেওয়া লাগবে?"
"আব্বা আমনে ব্যাপারডা একটু আমলে লন। হারুন ব্যাপারী আগেও ওই উকিলের কাছে গেছে। শেষে না আবার জমিখান হাতছাড়া হয়। কতবড় জমি!"
"জব্বার তুমি এইসব ছোডোখাডো বিষয় লইয়া আমারে বিরক্ত করবা না। জালাল তোমার ছোট ভাইরে বুঝাও। এইসব ছোডোখাডো বিষয়ে এত মাথা ঘামাইলে ভবিষ্যতে রাজনীতি কেমনে করবা তোমরা?"
এ কথার পর জব্বারের আর কিছু বলার সাহস হলো না। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে তার দুশ্চিন্তা কাটলো না।
সত্যি সত্যি প্রতিদিন রঞ্জু জেসমিনদের বাড়ির আশপাশ দিয়ে ঘুরঘুর করে। ঘুরে ঘুরে সে জেসমিনদের পুরো বাড়িটাই মুখস্ত করে ফেলল। জেসমিনের ঘর কোনদিকে তাও আবিস্কার করল। কোনো কোনোদিন জেসমিনকে না দেখেই ফিরে যেতে হয় তাকে। তবে সে এটা ঠাহর করতে পেরেছে যে প্রতিদিন বিকেলে জেসমিন তাদের বাড়ির দক্ষিনের ভিটায় প্রতিবেশী ছেলেপুলে ও ভাতিজা ভাতিজিদের সাথে খেলতে যায়। নানান রকম খেলা খেলে তারা। কখনো বৌছি, কখনো সাতচারা, কখনোবা আবার গোল্লাছুট। পাশেই খাল, মাছ ধরার ছুঁতোয় খালে বরশি পেতে বসে থাকে রঞ্জু। চোরা চোখে দেখে জেসমিনকে। ভেবে অবাক হয় সে! এত রূপ কী করে আল্লাহ একটি মানুষের মধ্যে দিল? যাকে একবার দেখে চোখ ফেরানো যায় না। বারবার দেখতে ইচ্ছা করে।
কিছুদিন যাওয়ার পর মাঝে একদিন রঞ্জু দেখে জেসমিন খেলছে না। চুপচাপ বসে আছে। সেদিন সে উপলব্ধি করলো শুধু জেসমিনের সৌন্দর্যেই মুগ্ধ না, সে জেসমিনের উচ্ছলতায়ও মুগ্ধ।
জেসমিন সন্ধ্যার আগে আগে খেলা শেষ করে হাত-পা ধুয়ে ঘরে ঢুকলো। কোহিনূর বানু ছরতা দিয়ে সুপারি কাটছিলেন।
জেসমিনকে দেখেই বললেন, "এত ডালে ডালে ঘুরোস ক্যা লো ছেড়ি? ডাকতে ডাকতে মইরা গেলেও তোরে পাওন যায় না।"
জেসমিন খুব অবাক হওয়ার ভান করে বলল, "ডালে ডালে কই ঘুরলাম মা? দক্ষিনের ভিডায় খেলছি। হেই ভিডা তো আমাগোই। তার মানে বাড়ির বাইরে যাই নাই। কোনো দরকার থাকলে তুমি কাউরে খবর দিয়া পাডাইতা।"
"এ দামড়া ছেড়ি খেলার কথা কইতে শরম করেনা? খেলার বয়স আছে তোর?"
"আছে দেইক্কাই তো খেলি। কী এমন বয়স অইছে আমার?"
"তোর বয়সে পোলা পয়দা কইরা মা অইসি আমি।"
"আমার তো আর বিয়া হয়নাই। কেমনে পোলা পয়দা করমু?"
কোহিনূর বানু এবার ভীষণ রেগে গেলেন। বললেন, "তোর বাপে আহুক খাঁড়া। বিয়া দিয়া এই আপদ যদি বিদায় না করছি! তোর মত মাইয়া সামলাইন্যা আমার কাম না।"
"কওগা যাইয়া।"
জেসমিন মুখ ঝামটা দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকলো। সন্ধ্যা হতেই পোকামাকড় ঢুকবে তাই সবার আগে জানালা লাগিয়ে দিল। পরনের শাড়িটায় কাদা লেগেছে, ঝটপট শাড়িটা পালটে ফেলল। তারপর হেরিকেন জ্বালালো, ঘরের ভেতর তেমন আলো ছিল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা নেমে আসবে। বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসল সে। পা নাচাতে নাচাতে চুলের বেনী খুলছিল, ঠিক তখনই টেবিলের উপর বইখাতার ভেতর একটা খাম দেখতে পেল। এই খামটা তো এখানে ছিল না। এটা কোত্থেকে এলো? জেসমিন খামটা খুলে দেখে ভেতরে একটা ভাঁজ করা কাগজ আর কিছু কামিনী ফুল। সে কাগজটা তুলে ভাঁজ খুললো। ভেতরে লেখা...
কোথাও কি এমন কলি হয়?
যে কলিতে ফুটলে ফুল
শুকাবে না তার পাঁপড়িগুলো
ঘ্রাণ রবে অক্ষয়?
প্রিয় জেসমিন,
এমন ঘ্রাণফুলের সাধ জেগেছে তোমাকে দেখার পর।
সাথে জাগলো মনে, এইতো প্রথম কিছু হারানোর ভয়।
ইতি রঞ্জু।
চিঠিটা কে দিল না জানা পর্যন্ত কোথাও কোনো শান্তি নেই জেসমিনের। হ্যাঁ চিঠির শেষে নাম লেখা আছে বটে, রঞ্জু। কিন্তু রঞ্জুটা কে? সে তো রঞ্জু বলে কাউকে চেনে না! পুরো কেশবপুরে কোনো রঞ্জু আছে বলেও শোনে নি কখনো। জেসমিনের মাথা ভালো। চিঠির মর্মার্থ বুঝতে তার কোনো সমস্যা হয়নি। বরং খুব ভালোভাবে বুঝেছে। এজন্য আরও বেশি অস্থির লাগছে। এমন আকুতি নিয়ে কে লিখলো তাকে?
খামের ভেতরের কামিনী ফুলের ঘ্রাণ নিলো সে। কামিনী ফুলের ইংরেজি নাম অরেঞ্জ জেসমিন। স্কুলের ইংরেজি স্যার বলেছিলেন, মনে আছে তার। সেটা জেনেই কি অচেনা মানুষটা তাকে কামিনী ফুল দিয়েছে? নাকি কাকতালীয়ভাবে মিলে গেছে?
জেসমিন এই নিয়ে চিঠিটা ২৯ বার পড়েছে। হাতের লেখাটাও মন কাড়া! আরও একবার পড়ে ৩০ পূরণ করলো। এরপর ভাঁজ করে বালিশের তলায় রেখে দিল।
জেসমিন খোলা চুলগুলো আঁচড়ে আবার বেঁধে নিল। তারপর পড়তে বসলো। কিন্তু কিছুতেই পড়ায় মন বসাতে পারলো না। পত্রদাতা মনের ভেতর ঢুকে খুব বিরক্ত করছে! মানুষটা যে চিঠিটা টেবিলের উপর রেখে গেছে এতেই বোঝা যাচ্ছে জানালা দিয়ে রেখেছে। এত বোকামি কেউ করে? চিঠিটা যদি অন্যকারো হাতে পড়তো? এমন অনেক প্রশ্ন মনের ভেতর ঘুরছে।
পরদিন জেসমিন সারাদিন কোথাও বের হলো না। নিজেকে ঘরবন্দী করে অপেক্ষায় রইলো। মানুষটা যদি চিঠি দিতে আবার আসে, অমনি তাকে ধরে ফেলবে! আচ্ছা সে এভাবে কেন চিঠি দিচ্ছে? জেসমিনের উত্তর দেয়ার তো কোনো সুযোগ নেই। একতরফাভাবে চিঠি দিয়ে কী লাভ?
আচ্ছা মানুষটার বয়স কেমন হবে? দেখতে কেমন সে? তাকে দেখে যদি জেসমিনের ভালো না লাগে? ভালো না লাগলে এই সুন্দর হাতের লেখার সুন্দর চিঠিটার জন্য তার ভীষণ মন খারাপ হবে!
সপ্তাহখানেক পার হয়ে গেল। চিঠি দিতে কেউ এলো না। জেসমিন আশা ছেড়ে দিল। ভাবলো বুঝি কেউ দুষ্টুমি করে চিঠিটা দিয়েছিল। অথচ সে বোকার মত সব বিশ্বাস করেছে!
তারপর এক বিকেলে জেসমিন আবার খেলতে গেল। অবাক কান্ড হচ্ছে তাদের খেলায় যাকে দুধভাত বানানো হয় সেই মতি খেলা শেষে ফেরার সময় একটা খাম দিল। খামটা দেখে ঘটনা বুঝতে বাকি রইলো না জেসমিনের।
সে খামটা হাতে নিয়ে জানতে চাইলো, "খামডা কেডা দিছে মতি?
মতি ঘার নেড়ে জবাব দিল, "চিনি না।"
জেসমিন ধমক দিয়ে বলল, "না চিনলে আনছোস ক্যা?"
মতি ঠোঁট উলটে বলল, "কইলো যে অনেক জরুলি কাম।"
"যে দিছে হে কি ব্যাডা না ছ্যামড়া?"
"ছ্যামড়া।"
"ধলা না কালা?"
"ধলা।"
"লম্বা না বাট্টু?"
"কইতারিনা।"
জেসমিন বিরক্ত মুখে বলল, "আচ্ছা যা তুই এহন।"
শাড়ির প্যাঁচের ভেতর খামটি লুকিয়ে বাড়ি ফিরলো সে। ইচ্ছে করেই খামটি খুললো না তখন। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার পর দরজায় খিল দিয়ে হারিকেনের আলো বাড়িয়ে খামটা খুললো। যথারীতি ভেতরে কামিনী ফুল এবং একটি চিঠি। আজকের চিঠি বেশ বড়। জেসমিন পড়া শুরু করলো,
আমার এলোমেলো মনের কারণ খুঁজতে গিয়ে
অহর্নিশি ভাবি তোমায়
নিত্য সন্ধ্যার শীতল কোমল আঁধার
স্পর্শ করে যায় আমায়
নিশুতি রাতের বুকে গলানো আকাশ ঝরে
চেয়ে থাকি অসীম এক প্রত্যাশায়
কখনো দেখি ঝড়ের আকাশে উড়ন্ত কোনো বিহঙ্গ
ডানা ঝাপটায় অচেনা কোনো সুখে,
মেঘের পরে মেঘ ছুটে যায় বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে
আমিও ছুটে যাই দুই ক্রোশ দূরে
দেখব বলে তোমায় বৃষ্টিস্নাত মুখে।
অথচ জানালায় দেখি বসে আছো একাকী অন্ধকার ঘরে
তখন আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে হয়
প্রেয়সী, তুমি কি মেঘ ভয়ে আছো ভীত?
প্রিয় জেসমিন,
গত সাত দিন তুমি ঘর থেকে বের হও নাই। জানিনা কেন সারাটা দিন জানালার কাছে বসে ছিলে। আমাকে হাতেনাতে ধরবে বলে নয়তো? তুমি জানালায় বসে ছিলে বলেই সেদিকে যাওয়ার আর সাহস করে উঠতে পারি নাই। আচ্ছা, তুমি এখন আর খেলতে যাওনা কেন? জানো, তোমার উচ্ছলতা আমাকে উচ্ছসিত করে! প্রতিদিন এত দূর থেকে তোমার সেই উচ্ছলতা দেখতে ছুটে যাই।
জানি তুমি ভাবছ কেন এভাবে লুকিয়ে চিঠি দিচ্ছি? সামনে কেন আসিনা? সামনে আসার মত সাহস নাই, যদি প্রত্যাখান করো? জানিনা তোমার মধ্যে কী আছে! শুধু জানি, প্রথম দেখায় তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি আমার কামিনী ফুল।
ইতি রঞ্জু।




পর্ব ৪
সামাজিক রোমান্টিক প্রেমের গল্প  "নাইওরি"  ।  @মিঃ বুদ্ধিমান গাধা
আজ আরও বেশি মেজাজ খারাপ হলো জেসমিনের। প্রেম নিবেদন করে বসেছে বাছাধন কিন্তু নিজের পরিচয় দেয়নি। দুই ক্রোশ দূর থেকে আসে উল্লেখ করেছে তার মানে দুই এক গ্রাম পার হয়ে তার বাড়ি। এর বেশি কিছুই জানার উপায় নেই। একতরফাভাবে চিঠি দিয়ে যাচ্ছে। কোনো উত্তর লাগবেনা তার? এ কোন রামবলদ?
জেসমিন এবার একটা দুই লাইনের চিঠি লিখলো। চিঠিটা এমন...
ভীতু রঞ্জুসাহেব,
সামনে আসার সাহস না থাকলে আর চিঠি দিয়েন না। ভীতুরা এই কামিনী ফুলের চোখের বালি।
ইতি জেসমিন।
পরদিন জেসমিন চিঠিটা মতির হাতে দিয়ে বলল, "যে আমারে চিডি দিছিল হে আবার আইলে এইডা হ্যারে দিবি।"
মতি ঠোঁট উলটে বলল,
"ক্যা দিমু?"
জেসমিন কটমট করে বলল,
"হ্যার চিডি আমারে ক্যা দিছিলি?"
"হে আমারে হাটের থিকা নারকলি আর বাদামের সন্দেশ কিন্যা দিছে।"
জেসমিন ভ্রুকুটি করলো। বাচ্চা ছেলেটাকে ঘুষ দিয়ে নষ্ট করছে লোকটা! সে বলল,
"আমারটা তারে দিলে আমি তোরে আমাগো খেলায় লমু। তোর আর দুধভাত থাহা লাগবে না।"
মতি দাঁত বের করে হেসে বলল,
"হাছা কইছো জেসমিন বু?"
"আল্লাহর কিরা।"
জেসমিন চোখ দুখানি বড় করে ফেলল। যেন তাকে অবিশ্বাস করা মতির মস্ত বড় অপরাধ।
জেসমিনের চিঠি পড়ে হেসে ফেলল রঞ্জু। তার এখন আর ঢাকা যাওয়ার জন্য কোনো হুতাশ নেই। 
বরং না যেতে পারলে সে বাঁচে। প্রতিদিন জেসমিনকে দেখতে যায়। মাঝে একদিন বাড়িতে কাজ থাকায় যেতে পারেনি। সেদিন যে কতটা অস্থিরতায় কেটেছে তা ভাষায় প্রকাশযোগ্য না। আজ যেতেই মতি এই চিঠিটা দিল। রঞ্জু সাথে করে আনা চিঠিটা আর দিল না, নতুন করে চিঠি লিখতে হবে। সে মতির কাছ থেকে কাগজ কলম নিয়ে চিঠি লিখতে পারতো অবশ্য। কিন্তু সে গভীর রাতে বারান্দায় বা জানালার ধারে বসে যে চিঠি লিখবে সেই চিঠিতে যতটা আবেগ, যত্ন মিশিয়ে দিতে পারবে তা কি এখন পারবে? অসম্ভব! 
বিশেষ মানুষটার জন্য সবকিছুই বিশেষ হওয়া চাই।
পরদিন জয়নাল মির্জা বাড়িতে থাকায় খেলতে যেতে পারেনি জেসমিন। সন্ধ্যার পর যখন জেসমিন পড়তে বসেছে তখন মতি বন্ধ জানালার ধারে এসে ডাক দিল,
"ও জেসমিন বু, আছো এহেনে?"
জেসমিন জানালা খুলে বলল,
"কী অইছে? তুই এত রাইতে আইছোস ক্যা?"
"রাইত কিয়ের? সন্ধ্যা অইছে হপায়। তুমি তো আইজ খেলতে আহো নাই তাই আইছি কি আর করমু? 
এই নেও তোমার চিডি।"
জেসমিন খামটা হাতে নিয়ে বলল,
"আইজ কী দিছে তোরে?"
মতি দাঁত বের করে বলল,
"কাইল হাটে লইয়া যাইব।"
"হাটে যাওনের আগে আমার লগে দেহা কইরা চিডি লইয়া যাইস।"
"আইচ্ছা বু।"
জেসমিন খামটা খুললো। কিছু কামিনী ফুলের পাশ থেকে চিঠিটা তুলে নিল।
প্রিয় জেসমিন,
তোমার কি কাঁচের চুড়ি পছন্দ? সেদিন যখন খেলছিলে, তোমার দু'হাতের চুড়িগুলো রিনিঝিনি করে বাজছিল। এর আগে কখনোই উপলব্ধি করতে পারি নাই কাচের চুড়ি জিনিসটা যে এত সুন্দর। 
নাকি তোমার হাতে উঠেছে বলেই তার মাধুর্য বেড়ে গেছে? সূর্যমনির হাটে সুন্দর কাঁচের চুড়ি ওঠে। 
হ্যাঁ ঠিক ধরেছ আমি সূর্যমনি গ্রামের ছেলে।
সুর্যমনিতে আমাদের বাড়ির দোতলায় আমার একলার রাজত্ব। ঘরের সামনেই বারান্দা। কিছুদিন আগে বারান্দায় একটা কাঠের চারকোনা টব বানিয়েছি নিজ হাতে। সেই টবে কামিনী ফুলের গাছ লাগিয়েছি। জানিনা ফুল কবে ফুটবে। আচ্ছা এই কামিনী গাছে পানি দেয়ার দায়িত্বটা কি তুমি নিবা ফুল?
তোমার চোখের বালি না। তোমার চোখের মণি হতে চাই। কখন কোথায় আসব বলে দাও। 
বান্দা সময়মতো হাজির হয়ে যাবে।
ইতি রঞ্জু।
চিঠি পড়তে পড়তেই জেসমিনের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। কিন্তু চিন্তার বিষয় হচ্ছে দেখা টা করবে কোথায়? কেউ দেখে ফেললে কেলেংকারি হয়ে যাবে। অন্তত কেশবপুরের মধ্যে কোথাও দেখা করা যাবে না। 
তাহলে উপায়?
জেসমিন রঞ্জুর প্রথম দেখা হলো মতিদের পানের বরে। মানিক পুরোটা সময় তাদেরকে পাহাড়া দিল। জেসমিন রঞ্জু দুজনের কারও কোনো ভয় নেই কিন্তু সে ভয়ে তটস্থ। এই সম্পর্কের কথা জানাজানি হলে কী হতে পারে সে ধারণা তার আছে। কারণ সে চেয়ারম্যানকে চেনে। চেয়ারম্যান হিসেবে লোক ভালো তবে স্বার্থে ঊনিশ-বিশ হলে সে অতি ভয়ংকর। রঞ্জুকে শত বুঝিয়েও লাভ হয়নি। ওদিকে জেসমিন যে দাপুটে মেয়ে, একবার স্কুলে এক ছেলে ওর চুলের বেনী ধরে টান দিয়েছিল বলে মেয়ে হয়েও সেই ছেলেকে যে ধোলাই দিয়েছিল, ভীর জমিয়ে দেখেছিল লোকে। সেই ঘটনা মুখে মুখে রটে গিয়েছিল। এরপর থেকে আর কোনো ছেলে চোখ তুলে তাকাতে সাহস পায়নি। আজ সেই মেয়ে রঞ্জুর চিঠি পড়ে পাগল হয়ে দেখা করতে এলো! কী এমন লিখেছে রঞ্জু!
রঞ্জুকে দেখে মাথা ঘুরছে জেসমিনের। এত সুদর্শন ছেলে এ তল্লাটে সে কখনো দেখেনি। জামাকাপড়, চালচলন, কথাবার্তা সবকিছুতেই একটা শহুরে ভাব। জেসমিনের সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। 
কিন্তু সে তার স্বভাবতই রঞ্জুকে সেসব বুঝতে দিতে চাইছে না। তাকে চুপ দেখে রঞ্জু বলল,
"কী ব্যাপার চিঠিতে তো খুব কথা শোনানো হয় আমাকে। এখন যে একদম চুপ?"
জেসমিন হেসে বলল,
"অত সুন্দর কইরা কথা কইতে পারিনা।"
"বেশি সুন্দর মানুষের অত সুন্দর কথা না বললেও চলে।"
"আপনে কি শহরে থাকেন?"
"আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। সেখানকার হলে থাকি। ইউনিভার্সিটি বন্ধ থাকলে গ্রামে থাকি।"
"এহন কি ইনভার্সিটি বন্ধ?"
"হ্যাঁ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। কিছু গন্ডগোল চলছে। তাই বাড়ি এসেছি।"
"তারমানে আমনে আবার ঢাকা যাইবেন গিয়া?"
"ইউনিভার্সিটি খুললে যাব।"
"আচ্ছা আমনের গ্রাম না সূর্যমনি? তাইলে কেশবপুরে কেমনে আইলেন আর আমারেই বা কেমনে পাইলেন?"
রঞ্জু প্রথম দেখার ঘটনাটা বিস্তারিত বলতেই জেসমিন চোখ পাকিয়ে বলল,
"ও! আমনেই হেই লোক, যার জন্য মায় আমারে গাইলাইছিল!"
রঞ্জুর ঘটনাটা মনে পড়ায় সে হেসে ফেললো। জেসমিন বলল,
"হাইসেন না। আমনেরে একখান কথা আগেই কইয়া রাখি, আমি কিন্তু কামচোর। আমারে দিয়া কোনো কাম করাইতে পারবেন না। ওই গাছে পানি দেওন পর্যন্তই।"
রঞ্জু হেসে ফেলল। এই মেয়েটি সবার থেকে আলাদা। এই মেয়েটিকে তার নিজের করে লাগবেই লাগবে।
তাদের পত্র আদান-প্রদান চলমান রইলো। দুই পক্ষেই ফিস বাড়িয়েছে মতি ডাকপিয়ন। ইদানীং বেশ বড় বড় আবদার করে বসে সে রঞ্জুর কাছে। রঞ্জুও হাসিমুখে সেই আবদার পূরণ করে। এই ডাকপিয়ন হারালে যোগাযোগ বন্ধ। এরচেয়ে বিস্বস্ত ডাকপিয়ন আর হয় না। দেখা খুব কমই হয়, তবে হয়। কখনো উত্তরের শাপলার বিলে, কখনো কালিশুরির মেহগনি বাগানে, কখনো মতিদের পানের বরে।




পর্ব ৫
সামাজিক রোমান্টিক প্রেমের গল্প  "নাইওরি"  ।  @মিঃ বুদ্ধিমান গাধা
হারাধন চক্রবর্তী উত্তরাধিকার সূত্রে বাপ দাদার অনেক জমিজমা পেয়েছিলেন। কিন্তু তার নগদ অর্থ ছিল না। তিনি অলস ও ভীরু প্রকৃতির হওয়াতে নিজে চাষবাস করতে পারতেন না। বর্গা দিয়ে দিতেন। পাকিস্তান আমলে একবার তার স্ত্রীর কঠিন অসুখ হয়। চিকিৎসার জন্য ভারত যেতে হবে। প্রচুর নগদ অর্থ প্রয়োজন। তিনি ছুটে গেলেন বিত্তশালী জয়নাল মির্জার কাছে। হারাধন চক্রবর্তীর জমিজমা সব এক দাগে কালিশুরিতে। এই কারণেই জয়নাল মির্জা কিনে নিতে চাইলেন। কিন্তু হারাধন চক্রবর্তী বিক্রি করতে নারাজ। তিনি জমি বন্ধকী দিয়ে কিছু টাকা নিতে চান। জয়নাল মির্জা বন্ধকী দলিলে হারাধন চক্রবর্তীর টিপসই নিয়ে টাকা দিলেন। জয়নাল মির্জা সেই জায়গা ভোগদখল করতে শুরু করলেন। বছর কয়েক বাদে হারাধন চক্রবর্তী টাকা ফেরত দিতে এলেন।
জয়নাল মির্জা বললেন, "আরে মিয়া রাখো তোমার টাকা। এই টাকার লগে আরো কিছু দেই আমি। 
জমি আমার ধারে বেইচা দাও। এমনেও এই জমি তুমি কামে লাগাও না। বর্গা দিয়া রাহো। 
তারচেয়ে নগদ ট্যাকা পাইলে তোমার কামে লাগব।"
হারাধন চক্রবর্তী আতংকিত হয়ে বললেন,
"জয়নাল ভাই, আমার টাকার অনেক দরকার আছিল তখন এই কথা সত্য। আমনের কাছে আমি ঋণী। 
কিন্তু বাপ দাদার জমি আমি বেচতে চাইনা দেইখাই বন্ধক রাখছিলাম। আমারে ক্ষ্যামা করেন।"
কিন্তু লাভ হয়নি। জয়নাল মির্জা টাকাও নেননি। জমির দখলও ছাড়েননি। এই জমির জন্য হারাধন চক্রবর্তী অনেক ঘুরেছেন জয়নাল মির্জার পেছনে। স্বাধীনতার পর তিনি চেয়ারম্যান হলেন। তার ক্ষমতা আরও বেড়ে গেল। কিছুতেই তার সাথে পেরে উঠলেন না হারাধন চক্রবর্তী। অবশেষে ভাবলেন জমি বিক্রিই করে দিবেন। কিন্তু জয়নাল মির্জা দাম বলেন নিতান্তই কম। ১০ ভাগের এক ভাগ। তারপর বিভিন্ন ধরনের হুমকিধামকি তো আছেই।
এরমধ্যেই হারাধনের পরিচয় হয় হারুন ব্যাপারীর সাথে। সে ঢাকার লোক। মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবার নিয়ে পালিয়ে এসেছেন। এখানে তার এক বন্ধু ছিলেন তিনিই তখন থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। এখানে থাকতে থাকতে এই জায়গার প্রতি তার প্রগাঢ় এক মায়া জন্ম নেয়। তিনি এখানেই স্থায়ী হতে চান। ঢাকা শহরের বাড়ি বিক্রি করে আসায় তার কাছে ম্যালা নগদ অর্থ। এখানে ভিটাবাড়িসহ কিছু জমিজমা ক্র‍য় করতে ইচ্ছুক। হারাধন চক্রবর্তী খবর পেয়ে তার ভিটাবাড়ি সব বিক্রি করে পাকাপাকিভাবে ভারত চলে গেলেন। সেখানে তার নানাবাড়ি।
হারুণ ব্যাপারী হারাধনের ভিটেবাড়িতে উঠলেন। সেখানে কোনো সমস্যা হলো না। কিন্তু ভেজালটা লাগলো কালিশুরির জমির বেলায়। জমিদখল নিতে এলে জয়নাল মির্জা হারাধনের টিপসই দেয়া দলিল বের করলেন। দলিলে স্পষ্ট যে ক্রয়সূত্রে এই জমির মালিক জয়নাল মির্জা। হারাধন লোক ছিল সোজা, পড়াশোনা জানতেন না। জয়নাল মির্জাকে বিশ্বাস করে দলিলে টিপসই দিয়েছিলেন। তার স্ত্রী তখন মৃত্যুর সাথে লড়াই করছেন তাই যাচাই বাছাইয়ের সময়ও তার ছিল না।
অন্যদিকে হারুণ ব্যাপারীর কাছেও ক্রয়সূত্রে পাওয়া দলিল রয়েছে। হারাধন চক্রবর্তীর সাথে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে হারাধনের বন্ধুর কাছ থেকে হারুণ ব্যাপারী জয়নাল মির্জার কারসাজির কথা জানতে পেরেছিলেন। তারপর থেকেই জয়নাল মির্জার সাথে হারুন ব্যাপারীর বিরোধ। সামনাসামনি তাদের সম্পর্ক মধুর। ভাবখানা এমন যে দুজনেই একই ব্যক্তি দ্বারা ঠকেছেন। তবে হারুন ব্যাপারীও ঝানু লোক। 
সে তার নগদ অর্থে কেনা জমি এত সহজে ছাড়বেন না।
মানিক গরিব ঘরের ছেলে। অল্প বয়স থেকেই সে খেয়াঘাটের মাঝি। প্রথমে বর্গা নৌকা চালাতো৷ বছরখানেক হলো নিজের নৌকা হয়েছে। বাপ বর্গাচাষী ছিল। এখন অসুস্থতার জন্য তিনি কাজ করতে পারেন না। 
ছোট ছোট ৫ ভাইবোন। সুতরাং পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মানিক। দিন আনি দিন খাই অবস্থা। জেসমিন রঞ্জুর প্রত্যেকবার দেখা করার সময় পাহাড়াদার হিসেবে থাকতে হয় তার। গরিবের ক্ষমতা সীমিত তাই ভয় অধিক। মানিকও তার ব্যতিক্রম নয়। চেয়ারম্যান সাহেব জানতে পারলে রঞ্জুর সাথে সাথে তার পরাণ টাও যাবে।
জেসমিন আজ ক্লাস না করে স্কুলের পেছনের খেয়াঘাট থেকে মানিকের নৌকায় উঠেছে। নৌকা কেশবপুরের সীমানার বাইরে যাওয়ার পর রঞ্জু নৌকায় উঠবে। এমনই পরিকল্পনা হয়েছে চিঠিতে।। 
মানিক দ্রুতহাতে বৈঠা বেয়ে পাড় থেকে দূরে চলে গেল। তবে এরজন্য বেশ কসরত করতে হলো। 
কারণ এখন ভাটার সময়। স্রোতের প্রতিকূলে দাঁড় টানতে হচ্ছে। তার জীবনের কোনোকিছুই স্রোতের অনুকূলে থাকেনা। আর এ তো নদীর স্রোত। এ আর কী!
জেসমিন গুনগুন করে কোনো একটা গান গাইছিল বোধহয়। রঞ্জু নৌকায় ওঠার আগেই মানিকের কথা সেড়ে ফেলা উচিত। জেসমিন বয়সে তারচেয়ে অনেক ছোট। তার ছোটবোনের সাথে এক ক্লাসে পড়ে। একই গ্রামের বাসিন্দা। কাছাকাছি বাড়ি। ছোট থেকে বড় হতে দেখেছে।
আচমকাই কথা শুরু করল মানিক,
"জেসমিন তোর ডর লাগে না?"
জেসমিন খুব স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিল,
"ইট্টু সাহস না থাকলে তো প্রেমে ডুব দিতাম না মানিক ভাই।"
মানিকের চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল জেসমিন। যেন এমন প্রশ্ন আসতে পারে জেনে উত্তরটা তৈরি রেখেছিল সে। এমন দৃঢ় দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না। মানিক এমনিতেও মেয়েছেলের দিকে তাকাতে অস্বস্তিবোধ করে। সে নদীর পানে চেয়ে দাঁড় বাইতে বাইতে বলল,
"সাহস ভালো। তয় সবকিছুতে না। লোক জানাজানি হইলে কেলেঙ্কারি লাগবে, তোর বদনাম হইবে জেসমিন।"
জেসমিন খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। মানিক বিরক্ত মুখে তাকালো। জেসমিন হাসতে হাসতেই বলল,
"চান্দেরও কলঙ্ক থাকে মানিক ভাই। আমিও তো চান্দের লাহান সুন্দর। আমার একটু কলঙ্ক না থাকলে কেমনে হয় কন ত?"
আজকের সূর্যের বড় তেজ। মানিকের ঘিলু যেন গলে পড়বে মনে হচ্ছে। দুশ্চিন্তায় আজ সে গামছা আনতে ভুলে গেছে। গামছা আনলে মাথাটা ঢেকে নিতে পারত। সে কিছুটা বিরক্ত মুখে বলল,
"তোগো দুইডার একটারও ডর ভয় বইলা কিছু নাই। একবার ভাবছোস চেয়ারম্যান চাচা জানতে পারলে কী হইব?"
"আমনে এক কাজ করেন মানিক ভাই। বন্ধুরে তালাক দিয়া দেন। তাইলে আর আপনের ফাঁসার চান্স নাই। 
যা যাইবো আমাগো উপর দিয়া যাইবো।"
মানিক জবাব দিল না। সে এমনিতেও কথা কম বলে।
নৌকা নদীর পাড়ে ভেড়ালো মানিক। রঞ্জুকে সেখানে একটা গাছের শেকড়ের উপর বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। নৌকা ভিরতেই রঞ্জু দ্রুত নৌকায় উঠে সোজা ছইয়ের ভেতর চলে গেল। মানিক নিজের মাথায় একটু পানি দিলো। তারপর আবার নৌকা ভাসালো। বৈঠা বাইতে শুরু করলো অজানার উদ্দেশ্যে। তার হাতে এখন অফুরন্ত সময়, যাওয়ার নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই। স্কুল ছুটির সময় হলে রঞ্জুকে আবার এখানে নামিয়ে তারা ফিরে যাবে। এই সময়টায় তার যা আয় হত তা রঞ্জু দিয়ে দেবে।
জেসমিন নৌকায় উঠেই শাড়ির আঁচল দিয়ে লম্বা ঘোমটা দিয়ে ফেলেছিল, যাতে বাইরে থেকে দেখলে কেউ চিনে না ফেলে। রঞ্জু তাকে এভাবে দেখে বলল,
"তোমাকে কিন্তু নতুন বউয়ের মত লাগছে ফুল।"
জেসমিন মুখ টিপে হেসে বলল,
"তাইলে বাড়ি লইয়া লও।"
"তুমি কি এখনই যেতে চাও? তাহলে বাবাকে বলে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাই?"
জেসমিন চোখ বড় বড় করে বলল,
"তুমি কি পাগল? আমি এমনেই তামশা করছি। আমার আব্বা এইসব টের পাইলে কাইট্টা ফালাইব।"
"ওমা তাহলে কি আমরা সারাজীবন এভাবে লুকিয়ে চুরিয়ে দেখা করে যাব?"
"না, আগে কাজকাম করো। বেকার পোলার কাছে আমার বাপে মাইয়া দেবে না।"
"দাঁড়াও দ্রুত বেকারত্ব ঘোচাচ্ছি। পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করব। তার আগ পর্যন্ত বাবার সাথে ব্যবসায় কাজ করি।"
রঞ্জু সত্যি সত্যিই তার বাবার সাথে ব্যবসায় কাজ করা শুরু করলো। তার বাবার বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা রয়েছে। যখনই ছেলে কাজ করতে চাইলো তিনি ভীষণ খুশি হয়ে ছেলেকে কাজে লাগিয়ে দিলেন।



পর্ব ৬
সামাজিক রোমান্টিক প্রেমের গল্প  "নাইওরি"  ।  @মিঃ বুদ্ধিমান গাধা
মিনু বহুদিন পর বাপের বাড়ি এলো। নতুন অতিথি আসার খবর পেয়ে মিনুর বাবা ইয়াসিন আলী মেয়েকে নাইওর নিতে গিয়েছিলেন। তিনি মেয়ের সাথে জেসমিনকেও বেড়াতে আনতে চাইলেন। জেসমিনের ইচ্ছা না থাকা স্বত্বেও জয়নাল মির্জার হুকুমে তাকে কুটুমবাড়ি আসতে হয়েছে। এমনিতে সে এবাড়িতে আসতে পছন্দ করে। মিনুর ছোট ছোট ভাই-বোন থাকায়, তাদের সাথে খেলে জেসমিনের সময় অনেক ভালো কাটে। কিন্তু এবার মন টিকছে না। রঞ্জুর জন্য অস্থির লাগছে। একটা খবরও দিয়ে আসতে পারে নি। এই ছেলেটা জীবনে আসার পর থেকে সবকিছুতেই তার অস্থির লাগে! এ কী ভয়ংকর অসুখ!
মিনুর মা ছালেহা রান্নাঘরে বসে তাল গোলাচ্ছেন। কলাপাতায় তালের পিঠা তৈরি হবে। তার হাতের এই পিঠা জেসমিনের অতি পছন্দের খানা। প্রতি বর্ষায় নিয়মিত এ বাড়ি থেকে তালের পিঠা যায় তার জন্য। 
আর সে এ বাড়ি বেড়াতে এলে তো তালের পিঠা বানানো আবশ্যক। জেসমিন রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে ছালেহার তাল গোলা দেখছে। ঠিক সেই সময়ে আচমকা রঞ্জুর গলা শুনতে পেল। পিলে চমকে গেল জেসমিনের। রঞ্জুর মত কন্ঠ, ডাকছেও রঞ্জুকে। বাড়ির পাশে রাস্তা। শব্দটা রাস্তার দিক থেকেই আসছে এবং অনেকটাই দূরে। কিন্তু জেসমিন তো এই গলাটা চেনে। রঞ্জুর তো এখানে আসার কথা নয়, আসা সম্ভবও নয়। মতির মাধ্যমে খবর নিতে পারে যে সে বেড়াতে এসেছে কিন্তু এ বাড়ির ঠিকানা তো পাওয়া সম্ভব না। তবে কি সে ভুল শুনেছে? ভুল শোনাটা অস্বাভাবিক নয়। হ্যাঁ ভুলই হয়তো শুনেছে। সত্যি হলে তো সালেহাও শুনতেন। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই ডাকটা আবার শুনতে পেল জেসমিন। রঞ্জু রঞ্জুকেই ডাকছে। এটা ভুল হতে পারে না। রঞ্জু এসেছে! কীভাবে এসেছে সে জানেনা তবে রঞ্জু এসেছে। রাস্তায় যে কেউ যে কাউকে ডাকতে পারে তাই হয়তো ব্যাপারটা আমলে নেন নি ছালেহা। তিনি তার কাজ করে যাচ্ছেন। জেসমিন অস্থির হয়ে পড়লো। যে করেই হোক তাকে রাস্তায় যেতে হবে।
জেসমিন ঘরে ঢুকলো। সবার চোখে ফাঁকি দিয়ে পেছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে সোজা রাস্তার দিকে চলে গেল। রাস্তার কাছেকাছি গিয়ে দেখে রঞ্জু আর মানিক দাঁড়িয়ে আছে। রঞ্জু আশেপাশে সবদিকে তাকিয়ে জেসমিনকে খুঁজছিল। তাই জেসমিন রাস্তায় উঠতেই রঞ্জু তাকে দেখে এগিয়ে গেল। জেসমিনের চোখে চোখ পড়তেই রঞ্জু হাসলো। জেসমিন হাসির উত্তর দিল না। তাকে ইশারা দিয়ে বাড়ির পাশের বাঁশ বাগানে যেতে বলে সে আবার বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। রঞ্জু বাঁশ বাগানে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। মানিক রাস্তায় দাঁড়িয়ে পাহাড়া দিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জেসমিন এলো। এবার সে রঞ্জুর হাসির উত্তরটা দিল। বলল,
"আমি যে এহেনে হেই কতা কেমনে জানলা?"
রঞ্জু হেসে বলল,
"মতি ডাকপিওন!"
"কিন্তু এই বাড়ি তো মতি চেনে না। ঠিকানা কোতায় পাইছো?"
"মানিক জোগাড় করেছে। আমি তো এদিকের কিছুই চিনিনা। মানিকই নিয়ে এসেছে।"
"সে কই?"
"রাস্তায় দাঁড়িয়ে পাহাড়া দিচ্ছে।"
"তোমার ডর লাগলো না আইতে?"
"কীসের ভয়?"
"ভিনগাঁয়ে দেহা করতে আইয়া যদি ধরা খাও?"
"তোমাকে দেখা এত জরুরি ছিল যে এসব মাথায়ও আসে নি।"
জেসমিন হেসে বলল,
"এই না হইলে প্রেমিক!"
জেসমিন রঞ্জুকে নিয়ে মিত্তির দিঘির দিকে গেল। দিঘিতে মিনুদের দুটি ডোঙা নৌকা বাঁধা। এই ডোঙা দুটিতে করে মিনুর ভাইবোনেরা দিঘিতে মাছ ধরতে যায়, শাপলা তুলতে যায়। জেসমিন এলে তাদের সাথে সে-ও যায়। তালগাছের কাণ্ড দিয়ে এই নৌকা বানানো হয়। ডোঙ্গা বেশ টেকসই। তাল গাছের কাণ্ড সহজে পঁচে না বলে একটি ডোঙা বেশ কয়েক বছর ব্যবহার করা যায়। তবে তালগাছের প্রস্থ কম হওয়াতে একসাথে বেশি মানুষজন ওঠা বিপজ্জনক। ডোঙায় যদি দুজন ওঠে তবে দুজনই বৈঠা বাইতে পারলে ভালো। 
জেসমিন রঞ্জুকে সাথে নিয়ে একটি ডোঙা ভাসালো। দুজনের হাতে দুটি বৈঠা। কিছুদূর যেতেই রঞ্জু বলল,
"তুমি আমাকে কিছু না জানিয়ে বেড়াতে এসেছ শুনে হঠাৎ করে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেছিল। 
অন্তত মতির কাছে একটা চিঠি দিয়ে আসতে পারতা।"
জেসমিন বৈঠা বাইতে বাইতে বলছিল,
"সুযোগ আছিল না। তালোইসাব আচুক্কা আইয়া পড়ছিল। চিডি একখান লেখছিলাম, কিন্তু মতির কাছে যাইতে পারি নাই।"
"তোমাকে না পেয়ে একটা অজানা ভয় কাজ করছিল।"
"যেকালে তোমার ইনভার্সিটি খুইল্যা যাইবে, হেকালে কী করবা?"
"তখন তো জেনেই ঢাকা যাব যে এতদিন দেখা হবে না। মানসিক প্রস্তুতি থাকবে।"
"এহ নিজে যাওনের সমায় এক্কালে ষোলো আনা। আর মাইনষের বেলায় এক আনাও না।"
রঞ্জু হেসে বলল,
"আচ্ছা যাও। পুরা ষোলো আনাই তোমার।"
জেসমিনের মুখে এবার হাসি ফুটলো। বলল,
"আচ্ছা এই দিঘির একখান কাহিনী আছে। হুনবা?"
"বলো।"
"এই গেরামের যত মাইনষের বিয়া লাগতো, বিয়ায় খাওনের সব থালাবাসন হাড়িপাতিল দিত এই মিত্তির দিঘি।"
রঞ্জু কৌতূহলী কন্ঠে জানতে চাইলো,
"কীভাবে?"
"কারো বিয়া লাগলে পাত্রপাত্রীর বাপ মা এহেনে আইয়া কইত, অমুক দিন আমার মাইয়ার বিয়া। 
পোলার বাপেরা কইত আমার পোলার বিয়া। আমারে কিছু থালাবাসন হাড়িপাতিল দাও গো মিত্তির দিঘি। পরদিন বেইন্যাকালে দিঘিরপাড়ে পিতলের হাড়িপাতিল আর সোনা রূপার থালাবাসন পাওন যাইত। বিয়া মিট্যা গেলে থালাবাসন হাড়িপাতিল গুলা আবার মাইজ্যা ধুইয়া দিঘিরপাড়ে থুইয়া দিতে হইত। দিঘি রাইতেরবেলা ফেরত নিয়া নিত। একবার হইলো কি এক ব্যাডা হের মাইয়ার বিয়ার লাইগা থালাবাসন নিলো। বিয়ার কাম শ্যাষ হইতেই সব আবার মাইজ্যা ধুইয়া দিঘিরপাড়ে থুইয়া গেল। কিন্তু পরদিন দেখে থালাবাসন পাড়েই রইসে। দিঘি ফেরত নেয় নাই। এমনে আরও একদিন এক রাইত গেল। থালাবাসন পাড়েই পইড়া রইছে। ব্যাডায় তো ম্যালা দুশ্চিন্তায় পইড়া গেল। দিঘি থালাবাসন নিতাছে না এইডা তো ভালো লক্ষন না। হেইদিন রাইতেই হে স্বপ্নে দেখলো থালাবাসন সব যায় নাই। এর লাইগ্যা দিঘি ফেরত নিতাছে না। কি সর্বনাইশা কথা! মিত্তির দিঘির জিনিস চুরি! শ্যাষম্যাশ ব্যাডা বাড়ির বেবাকটিরে ডাইক্যা কইলো কেউ কিছু চুরি করলে রাইতে জায়গামত রাইখা আইতে। আর নাইলে এই বংশ ধ্বংস হইয়া যাইব। আসলে ওই ব্যাডার পোলার বউ এত সুন্দর নকশা করা সোনা রূপার থালাবাসন দেইখা লোভে পইড়া একটা বাটি পলাইয়া রাখছিল। যাই হোক, পরে বৌ ওই রাইতেই বাটিটা ফেরত রাইখা আইছিল। হেই যে হেই দিন রাইতে দিঘি সব থালাবাসন নিল, এরপর আর কোনোদিন কাউরে দেয় নাই। কত মানুষ চাইলো! দিঘির পাড়ে আর থালাবাসন আহে না।"
রঞ্জু হেসে বলল,
"এটা তোমার বানানো গল্প তাইনা?"
জেসমিন রেগে গেল,
"বানাইন্যা হইবে ক্যা? তুমি এই গেরামের মিত্তির দিঘির কথা যে কাউরে জিগাও গা যাইয়া, সবাই জানে। 
এই জেসমিন মিছা কথা কয় না।"
রঞ্জু কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই তীরের দিক থেকে একটা হুংকার শোনা গেল,
"এই... ডোঙায় তোমরা কার পোলা? কার মাইয়া?"
সাথে সাথে আরেকজনের গলা পাওয়া গেল,
"মাইয়ার তো চেহারা দেহা যায় না। পোলাউজ্ঞারে ত দেইক্কা মনে হয় না এই গেরামের।"
"কি সর্বনাশ জোয়ান মাইয়াপোলা একলগে ডোঙা বায়! দ্যাশটা তো এক্কালে রসাতলে গেল।"
রঞ্জু সেদিকে তাকালো। জেসমিন একজনের গলা শুনে চিনতে পারলো। এটা ইয়াসিন আলীর গলা। 
তারা জেসমিনের পেছন দিকে। সে আর পেছনে তাকালো না। রঞ্জুকে বলল,
"এই তুমি ওইদিক চাইয়ো না। শ্যাষের জন আমার তালোই। তাড়াতাড়ি ডোঙা বাও। এদিক থিকা পলাইতে হইব। আমার চেহারা দেহান যাইবো না।"
ইয়াসিন আলীর গলা আবারও শোনা গেল। তবে আগের মত চেঁচিয়ে না বলায় বোঝা গেল না।
রঞ্জু বলল,
"সর্বনাশ। ওরা একটা নৌকায় উঠেছে। এদিকেই আসছে।"
"নৌকা না ডোঙা?"
"নৌকা।"
"ডোঙা বাইয়া নৌকার লগে জীবনেও পারমু না। তুমি সাতার জানো?"
"জানি।"
"তয় এহনই লাফ দাও। সাঁতরাইয়া পলাইতে হইবো।"
রঞ্জু জেসমিনের হাত ধরে দিঘিতে লাফ দিলো। জেসমিন খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। ডুবসাঁতার দিয়ে দুজনে যে কোনদিকে গেল, ইয়াসিন আলীরা আর খুঁজে পেলেন না।
জেসমিন চোরের মত পেছন দিকের রাস্তা দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকলো। লুকিয়ে ঘরে ঢুকে দ্রুত কাপড়টা পালটে ফেলল। এর কিছুক্ষণ বাদেই মিনু এসে বলল,
"জেসমিন তুমি কাইল সকালে বাড়িত চইলা যাও। আমাগো বাড়ি বইয়া ধরা খাইলে বিপদের ভাগিদার আমরাও হমু। আমি আমার বাপেরে এই বয়সে বিপদে ফালাইতে চাই না।"
মিনু জেসমিনের উত্তরের অপেক্ষা না করে চলে গেল। রাতে খাবারের সময় মিনু ইয়াসিন আলীকে বলল, "আব্বা জেসমিন বাড়ি যাইতে চায়। কাইল ব্যানে(সকালে) আমনে অর যাওনের ব্যবস্থা করেন।"
ইয়াসিন আলী বিচলিত হয়ে বললেন,
"ক্যা মা কী অইছে? আম্মাজানের কি কোনো সমেস্যা অইতেয়াছে এহেনে?"
"এত ভাইবেন না আব্বা। সে বড় হইছে। যাইতে যখন চায় যাওনের ব্যবস্থা করেন।"
জেসমিনকে কিছু বলারই সুযোগ দিল না মিনু। অবশ্য জেসমিনের বলারও কিছু নেই। যেতে পারলে বরং ভালো।
"আচ্ছা বেইন্যাকালে আমি লইয়া যামু।"
ইয়াসিন আলী এ কথা বলে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন। মিনু যখন এভাবে বলছে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে।
রাতেই জেসমিনের জ্বর এলো। দিঘিতে অনেকক্ষণ সাঁতরানোর ফলে ঠান্ডা লেগে জ্বর। খুব বেশি জ্বর নয় যদিও। সে ব্যাপারটা কাউকেই বুঝতে দিল না। বাড়ি চলে এলো। অসুস্থ অবস্থায় অনেকটা পথ নৌকা করে আসায় জ্বর বেড়ে গেল। নৌকার ঘাটে দেখা হয়ে গেল মানিকের সাথে। ইয়াসিন আলী নৌকার ভাড়া মেটানোর সময় জেসমিন মানিকের কাছে গিয়ে বলল,
"কী মানিক ভাই বন্ধুরে তালাক দিতে পারলেন না? ভিন গায়ে গেলেন গিয়া তার প্রেমিকার কুটুমবাড়ি চিনাইতে!"
মানিক বলল,
"তালাক ক্যান দিমু? সে আমার বন্ধু। তারে ভালমন্দের বুঝ দেওন দায়িত্ব ছিল তাই দিসি। তার ভালোর লগে যেমন থাকি মন্দের লগেও থাকি৷ তাই আছি। লাগলে তার লাইগা জান দিমু। কুটুমবাড়ি চিনানো তো কিছুই না।"
"আমার ব্যাপারটাও এমনই হইয়া গেছে মানিক ভাই। লাগলে জান দিতে পারমু কিন্তু তারে ছাড়া থাকতে পারমু না।"
মানিক ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো। ইয়াসিন আলী আসার আগেই জেসমিন মানিকের কাছ থেকে সরে গেল।
রাত তখন অনেক। জানালায় দুটো টোকা পড়ল। মতিকে বলা আছে জরুরি প্রয়োজনে এসে যদি জানালা বন্ধ পায় তাহলে হালকাভাবে দুটো টোকা দেবে। তখনই জেসমিন বুঝবে মতি এসেছে। জ্বর নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠতে কষ্ট হলো জেসমিনের। তবুও সে উঠলো। নিশ্চয়ই রঞ্জুর কোনো খবর হবে। জানালা খুলতেই চমকে উঠল জেসমিন। রঞ্জু দাঁড়িয়ে! ফিসফিসিয়ে বলল,
"তুমি এত রাইতে এহেনে?"
"তোমার জ্বর খবর পেয়ে এলাম। জ্বর বাধালে কী করে? সাঁতার কেটে?"
"মনে হয়। আইনকা পানি তো। কিন্তু তুমি খবর পাইলা কেমনে?"
"মানিকের কাছে। খেয়াঘাটে নাকি দেখা হয়েছিল।"
"ও। জানো একটা গন্ডগোল হইয়া গেছে।"
"কী গন্ডগোল?"
"ছোট ভাবির কাছে ধরা খাইয়া গেছি।"
"সর্বনাশ। কীভাবে?"
"তা জানি না। ভাবির লগে এই বিষয়ে আর আলাপ করার সাহস পাইতাছিলাম না।"
"যদি তোমার বাবাকে বলে দেয়?"
"তা কইবে না। সে তার নিজের আব্বারেও কয় নাই।"
"আচ্ছা।"
জেসমিন আচমকাই বলে উঠলো,
"কপালে হাত দিয়া জ্বর দেখতে মনে চায় এইটা মুখে কইতে ডরাও? ক্যামন পুরুষ তুমি?"
রঞ্জু হেসে বলল,
"তুমি কীভাবে মন পড়তে পারো জেসমিন?"
"মন পড়তে হইলে চক্ষু লাগে। আর হেইডা আমার আছে।"
জেসমিন জানালার একদম কাছে চলে গেল। রঞ্জু কপালে হাত রাখলো।
জেসমিন কেঁপে উঠলো।
মনে হলো বরফের হাত বসেছে তার কপালে।
এই হাত তার প্রিয় মানুষষের হাত! সে চোখটা বন্ধ করে প্রার্থনা করে নিল, 
এই হাত যেন আজন্মকাল তার কপাল ছোঁয়ার অধিকার পায়।




পর্ব ৭
সামাজিক রোমান্টিক প্রেমের গল্প  "নাইওরি"  ।  @মিঃ বুদ্ধিমান গাধা
দুপুর পেরিয়ে বিকেল হতে চলেছে। রঞ্জুকে উঠোনে একটা গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। উঠোন ভর্তি লোকজন। সালিশ বসবে একটু পরেই। শুধু চেয়ারম্যান সাহেবের অপেক্ষা। গ্রামের অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও এসে পড়েছেন। মাঝরাতে রঞ্জুকে জেসমিনের জানালার সামনে থেকে ধরে আনা হয়েছে, সারারাত সে এই গাছের সাথেই বাঁধা। কাঠফাটা রোদে মগজ গলে পড়ছিল যেন। এখন রোদটা মরে এসেছে। কিন্তু প্রচন্ড ক্ষুদায় কাতর সে, শরীরের সব শক্তি শেষ।
মানিক টের পেয়েছে দুপুরে। কিন্তু রঞ্জু সবার চোখের সামনেই। পাহাড়াও দেয়া হচ্ছে তাই ধারেকাছেও যেতে পারেনি সে। তাই সে এখন রঞ্জুর বাবার কাছে যাচ্ছে খবর দিতে। চেয়ারম্যানের ভয়ংকর কোনো শাস্তির হাত থেকে হয়তো একমাত্র উনিই বাঁচাতে পারবেন রঞ্জুকে।
যেহেতু রাতে ধরা পড়েছে সেহেতু সালিশ সকালেও হতে পারতো। কিন্তু চেয়ারম্যান সাহেব নাকি আজকে কঠিন ব্যস্ত। মেয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর কি কিছু থাকতে পারে? মানিক ভালোভাবেই জানে, ব্যস্ততা আসলে কিছুই না। অপরাধীকে যাতে সালিশ হবার আগেই অভুক্ত অবস্থায় বেশিক্ষণ বেঁধে রেখে কষ্ট দেয়া যায় তাই এই ব্যস্ততার নাটক। এই নাটক শুধু সে নয় গ্রামের অনেকেই বোঝে কিন্তু কিছু করার নেই। বড় বড় মানুষের বড় বড় ব্যাপার। গরীবের না আছে কিছু বলার ক্ষমতা, না আছে কিছু করার ক্ষমতা। গরিব সর্বক্ষেত্রেই অক্ষম!
রঞ্জু ধরা খাওয়ার পর থেকে জেসমিনকে ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছে। জেসমিন কেঁদেকেটে একাকার করেছে। ঘরের ভেতর থেকেই বারবার রঞ্জুকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুনয়-বিনয় করেছে সে। কেউ তেমন একটা গায়ে মাখেনি। তবে কোহিনুর বানু একবার এলেন। জানালা খুলে ঠান্ডা গলায় বললেন, "বেশি চিল্লাইলে গরম শিক আইন্যা গলায় ঢুকাই দিমু।"
জেসমিন ফুসে উঠলো,
"দেও। আমারে মাইরা হালাও। খালি রঞ্জুরে ছাইড়া দিতে কও মা। আল্লাহর দোহাই লাগে।"
"পোড়াকপালি! পিরিত মারানির আগে মনে আছিলো না কী অইতে পারে? তোর আহ্লাদির ঠেলায় জোয়ান পোলাডার জীবন দিতে অইবে এহন।"
জেসমিন পা দাপিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
"মাফ কইরা দেও মাগো, মাফ কইরা দেও।"
"আমার বাপে আইলেও তোর বাপেরে আইজকা আটকাইতে পারবে না লো সর্বনাশী ছেড়ি৷ যে সর্বনাশ তুই করছোস, হেইয়া এহন চক্ষু মেইল্যা দ্যাকতে অইবে।"
জয়নাল মির্জা সালিশে যাওয়ার আগে জেসমিনের ঘরে ঢুকলেন। জেসমিন বিছানায় বসে ছিল। বাবাকে দেখে নেমে এলো। তবে বাবাকে সে ভীষণ ভয় পায়। তার মুখের উপর কোনোদিন কথা বলেনি। জয়নাল মির্জা বললেন,
"কী বলি মনোযোগ দিয়া শোনো মা। সালিশে তোমারে ডাকা হবে। ছেলে যাই বলুক তুমি বলবা এই ছেলে তোমারে পছন্দ করে, তবে তুমি কখনই তার ডাকে সাড়া দাও নাই। এই কথার যেন নড়চড় না হয়। তার জীবনে সর্বনাশ ডাইকা আনবা না আশা করি।"
জেসমিনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন।
সালিশ শুরু হবার আগেই রঞ্জুর বাবা এসে উপস্থিত হলেন। তাকে দেখে জয়নাল মির্জার মাথায় চক্কর দিয়ে উঠলো। কারণ রঞ্জুর বাবা হারুন ব্যাপারী। এই ছেলে যে হারুন ব্যাপারীর ছেলে সেটা যদি তিনি আগে জানতেন তবে খেলার চাল ঘুরিয়ে দিতে পারতেন। ঘুনাক্ষরেও সালিশ ডাকতেন না। এই ছেলেকে তুরুপের তাস বানিয়ে জমির ঝামেলাটা মিটিয়ে ফেলতে পারতেন।
তিনি সবসময় ভেবেচিন্তে প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করেন। সেই হিসেবে তার প্রথমে খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল ছেলেটির বাবা কে? কিন্তু এইক্ষেত্রে নিজের মেয়ের প্রণয়ের সম্পর্ক ধরা পড়ায় তার মাথা আউলে গিয়েছিল। ছেলেটিকে কঠিন শাস্তি দেওয়ার জন্য গায়ের রক্ত টগবগ করে ফুটছিল। সেইজন্যই সালিশ ডেকে বসলেন।
কেশবপুরের সকল সালিশে সাধারণত চেয়ারম্যান জয়নাল মির্জা, মেম্বার কাশেম মোল্লা, কেশবপুর বাজারের একমাত্র ডাক্তার প্রনব সাহা, কেশবপুর হাই স্কুলের হেডমাস্টার নাসেরউদ্দিনসহ গ্রামের প্রভাবশালী অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও আসেন। সকলের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। যেহেতু ভিকটিম চেয়ারম্যান সাহেবের কন্যা সেহেতু বিষয়টি স্পর্শকাতর। সকলেই এসেছেন। যে ছেলে চেয়ারম্যান সাহেবের কন্যাকে রাতবিরাতে উত্যক্ত করতে পারে, অবশ্যই সেই ছেলের কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত।
প্রথমেই জেসমিনকে ডাকা হলো। সে যেহেতু ভিকটিম তার কথাই আগে শুনতে হবে। জেসমিনের গায়ে জ্বর, শরীর কাঁপছে। তাকে ধরে আনলেন কোহিনূর বানু। রঞ্জু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সালিশ শুরুর আগে অবশ্য তার বাঁধন খুলে দেয়া হয়েছে। চেয়ারম্যান সাহেবের পুত্রদ্বয় পাশেই দাঁড়ানো। হারুন ব্যাপারী অন্য গ্রামের হলেও প্রভাবশালী এবং সম্মানীয় লোক। তাই অপরাধীর বাবা হওয়া স্বত্তেও তাকে বিচারকারীদের সাথেই বসতে দেয়া হয়েছে। তিনি কোনো কথা বলছেন না, চুপচাপ দেখছেন। খবর পেয়ে এখানে আসতে আসতেই খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিকল্পনা করে ফেলেছেন তিনি তবে তার আগে জেসমিনের বক্তব্য শোনা দরকার। জেসমিন এবং রঞ্জুর বক্তব্যের উপর নির্ভর করছে তার পরিকল্পনা কাজে লাগানো যাবে নাকি যাবে না।
সকল সালিশ চেয়ারম্যান সাহেবই শুরু করেন তবে এই সালিশ শুরু করার দায়িত্ব তিনি দিয়েছেন মেম্বার কাশেম মোল্লাকে। প্রয়োজনে তিনি তার বক্তব্য পেশ করবেন। কাশেম মোল্লা জেসমিনকে জিজ্ঞেস করলেন,
"বলো মা, এই ছেলে কবে থেইক্যা তোমারে উত্যক্ত করে?"
জেসমিন কিছু বলার আগেই প্রণব সাহা বললেন,
"আগে গতকাল রাইতের ঘটনাটা জেনে নিলে ভাল হয় না?"
আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ দিল না জেসমিন। সে দৃঢ় গলায় বলল,
"সে আমারে উত্যক্ত করে নাই। আমি তারে ভালোবাসি, সেও আমারে ভালোবাসে। আমার জ্বর হইছে সেই খবর পাইয়া সে আমারে দেখতে আসছিল। আমি ঘরে, সে বাইরে। জানলা দিয়া কথা কইতাছিলাম আমরা। তখনই বড় ভাইজান দেইখ্যা ফালায়। তারে ধইরা নিয়া বাইন্ধা রাখে। সে যদি অপরাধ করে তাইলে আমিও অপরাধ করসি।"



পর্ব ৮
সামাজিক রোমান্টিক প্রেমের গল্প  "নাইওরি"  ।  @মিঃ বুদ্ধিমান গাধা
সালিশের বিচারকারী সকলেই জেসমিনের কথা শুনে নিজেরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। মুহূর্তের মধ্যেই নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান পুরুষ মনে হতে লাগলো রঞ্জুর। সে জানতো জেসমিন সাহসী। তাই বলে যে একগ্রাম লোকের সামনে, নিজের বাবা ভাইদের সামনে, ভালোবাসার কথা বলার মত সাহস রাখে সেটা সে কল্পনাও করেনি। জয়নাল মির্জা রক্তবর্ণ চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু জেসমিন তার দিকে তাকাচ্ছে না। সে শুধু একবার রঞ্জুর দিকে তাকিয়েছিল। তারপর থেকেই মাথা নিচু করে আছে। মানুষটার ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত অসহায় মুখটা দেখে নিজেকে অপরাধী লাগছে।
হেডমাস্টার নাসেরউদ্দীন বললেন,
"রঞ্জু তোমার কি বক্তব্য?"
রঞ্জু বলল,
"আমি জেসমিনকে ভালোবাসি। সে আমাকে ভালোবাসে কিনা সেটা তার নিজের মুখেই আপনারা শুনেছেন। আমি শুধু ওকে ভালোই বাসিনা, সম্মানও করি। তাই আমি চাইনা তার সম্মান নষ্ট হোক। আমি ঢাকা শহরে জম্মেছি, সেখানেই বড় হয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বাবা গ্রামে স্থায়ী হলেও আমার সেভাবে গ্রামে থাকা হয়ে ওঠেনি। পড়াশোনার জন্য আমি ঢাকাতেই থাকি। তাই গ্রামের নিয়মকানুন সেভাবে জানিনা। যদি কোনো অন্যায় করে থাকি তাহলে আমাকে শাস্তি দেবেন। তবে আমার অনুরোধ জেসমিনকে যেন অসম্মানিত করা না হয়।"
রঞ্জুর কথা শেষ হতেই হারুন ব্যাপারী বললেন,
"আপনারা অনুমতি দিলে আমি কিছু কথা বলতে চাই।"
সবার আগে জয়নাল মির্জা বললেন,
"বলেন জনাব, আপনার ছেলে অপরাধ করছে আপনার তো বলতেই হবে।"
হারুন ব্যাপারী অপমান গায়ে মাখলেন না। হেসে বললেন,
"প্রেম ভালোবাসা যদি অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে আমার পুত্র যেমন অপরাধ করেছে, চেয়ারম্যান সাহেবের কন্যাও অপরাধ করেছে। তবে তাদের বয়স কম, আবেগ বেশি। তারপরেও যখন এত মানুষের সামনে তারা উভয়েই ভয়, লজ্জা, সম্মানের তোয়াক্কা না করে তাদের ভালোবাসার কথা স্বীকার করেছে তখন আপনারা বুঝতেই পারছেন তারা একে অপরকে প্রচন্ড ভালোবাসে। এবং তারচেয়েও বেশি আমি আমার ছেলেকে ভালোবাসি। নিশ্চয়ই চেয়ারম্যান সাহেবও তার কন্যাকে অকৃত্রিমভাবে ভালোবাসেন। তাই আমি মনে করি এর একটা সুন্দর সমাপ্তি হতে পারে। চেয়ারম্যান সাহেব এবং উপস্থিত সকলের কাছে আমি রঞ্জুর ও জেসমিন বিবাহের প্রস্তাব দিচ্ছি। আপনারা সকলে রাজী থাকলে শুভ দিন দেখে আমরা দুজনের বিবাহ সম্পন্ন করতে পারি। এতে ওরা দুজন সুখী হবে এবং সকলের সম্মান বজায় থাকবে।"
প্রস্তাব শুনে জয়নাল মির্জার ভীমড়ি খাবার জোগাড়। প্রনব সাহা বললেন,
"অতি উত্তম প্রস্তাব। ছেলের বাবা বিয়ের প্রস্তাব দিলে এরপর তো আর কথাই থাকে না। মিয়ারা কী বলেন?"
একে একে দেখা গেল সকলেই হারুন ব্যাপারীর প্রস্তাবে একমত। শুধু জয়নাল মির্জা চুপ করে রইলো। বেশকিছুক্ষণ পর সে বলল,
"আমার একটু ভাবতে হইবো। জেসমিন আমার একমাত্র মাইয়া। তার ব্যাপারে এত জলদি সিদ্ধান্ত নেওয়া আমার পক্ষে মুশকিল।"
নাসেরউদ্দীন বললেন, "চেয়ারম্যান সাব, সালিশের সিদ্ধান্ত সালিশেই নেওয়া ভালো। নাইলে পরে লোকে নানান কথা কইব। বিগত দিনে এই ধরনের মামলায় তো দেখছেন ব্যাপারগুলা পরে কেমন হয়।"
কাশেম মোল্লা বললেন,
"হ নুরুর মাইয়ার বেলাতেও তো এমন হইছিল। বিয়ার তারিখ কয়দিন পরে দেওয়াতেই ত লোকে বিয়ার আগ পর্যন্ত নানানরকম কথা হুনাইছে।"
প্রনব সাহা বললেন,
"আমার মতে, বিয়ে হলে আজকে হয়ে যাওয়াই ভালো।"
তারপর হারুন ব্যাপারীকে জিজ্ঞেস করলেন,
"আজকে বিবাহ পড়াইলে আপনার কোনো আপত্তি আছে?"
হারুন ব্যাপারী বললেন,
"আমার কোনো আপত্তি নাই। আমি আমার ছেলের জন্য যেকোনো মুহূর্তেই প্রস্তুত। আপনারা বললে আমি আজকেই বিবাহের ব্যবস্থা করব।"
জয়নাল মির্জা বললেন,
"বিয়ার ব্যবস্থা পোলার বাপ করে না মিয়া। করে মাইয়ার বাপ। জালাল হুজুররে খবর দাও। আইজকাই ওগো বিয়া পড়ানো হইব।"
জালাল কাছে এসে বলল,
"আব্বা আপনের মাথা কি ঠিক আছে?"
জয়নাল মির্জা চোখ রাঙিয়ে বললেন,
"আমার চেয়ে বেশি বুঝার চেষ্টা করবা আমি মরনের পরে। যা বলা হইছে তাই করো গিয়া।"
বাদ মাগরিব রঞ্জু ও জেসমিনের বিবাহ সম্পন্ন হলো। যাকে সারাদিন অভুক্ত অবস্থায় গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছিল তাকেই এখন জামাই আদর করে খাওয়ানো হচ্ছে। রঞ্জু অবশ্য খেতে পারছেনা। বমি এসে পড়ছে তার। মাথা ঘুরাচ্ছে। কোনোমতে হাত নাড়াচাড়া করছে। সময়টা পেরিয়ে গেলে সে বাঁচে। গায়ে একফোঁটা শক্তি নেই। আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে স্থির থাকার। কিন্তু যেকোনো মুহূর্তে জ্ঞান হারাতে পারে।
জেসমিনকে এখনই শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যাবেনা, রঞ্জুকেও এবাড়িতে রাখা হবেনা। আগে আনুষ্ঠানিক বিয়ে সম্পন্ন হবে এরপর দুজনের বাসর হবে। আনুষ্ঠানিক বিয়ের তারিখ দেয়া হলো সপ্তাহখানেক বাদে। তখনই জেসমিনকে উঠিয়ে নেয়া হবে। তাই রঞ্জু চলে যাওয়ার আগে জেসমিনের ঘরে তাদের দুজনকে কিছুক্ষণের জন্য কথা বলতে দেয়া হলো। এর পেছনে অবশ্য জেসমিনের বড় ভাবি আসমার অবদান সবচেয়ে বেশি। সেই প্রথম বলেছে, নববিবাহিত দম্পতিকে অন্তত কিছু সময়ের জন্য হলেও কথা বলতে দেয়া উচিত। তার উপর যে ঝড় আজ সারাদিন দুজনের উপর দিয়ে গেছে তাতে এটা না হলেই না।
রঞ্জু ঘরে ঢুকতেই জেসমিন মাথা নিচু করে অপরাধীর গলায় বললো,
"আমারে মাফ কইরা দেও।"
রঞ্জু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। বলল,
"কেন? তুমি কী করেছ?"
"আমার পাগলামির কারণেই কাইল ধরা খাইছি। তুমি চইল্যা যাইতে চাইছিলা, আমি বারবার তোমারে আটকাইছি।"
রঞ্জু মৃদু হেসে জেসমিনের হাত দুটি নিজের দুহাতে ধরে বলল,
"ভাগ্যিস আটকেছিলে। নাহলে এত তাড়াতাড়ি তোমাকে পেতাম কীভাবে?"
জেসমিন মুখ তুলে তাকালো। তারপর অশ্রুসিক্ত নয়নে বলল,
"কিন্তু তোমারে রাইতভর বাইন্ধা রাখলো। বড়ভাইজান তোমার গায়েও হাত তুলল। কতবড় অপমান!"
"মাঝরাতে দেখা করতে এসে প্রেমিকার বাপ ভাইয়ের কাছে ধরা পড়লে এরচেয়ে ভয়ংকর কিছুও হতে পারতো। যা হয়েছে তা অপমান হিসেবে না দেখে শাস্তি হিসেবে দেখো।"
জেসমিনের চোখ বেয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। রঞ্জু তা যত্ন করে মুছে দিয়ে বলল,
"কাল থেকে অনেক কেঁদেছো। এই সুন্দর চোখে আর যেন জল না দেখি। তোমার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে জেসমিন। মাথায় পানি ঢালতে হবে। দাঁড়াও আসমা ভাবিকে ডাকি।"
রঞ্জু দরজার দিকে যাচ্ছিল। জেসমিন একটা হাত ধরে তাকে থামালো।
"না খাঁড়াও ভাবিরে ডাক দিও না।"
"কেন? ভাবিকে না ডাকলে পানি পাব কোথায়?"
জেসমিন রঞ্জুর হাতখানা ধরে নিজের কপালে রেখে বলল,
"তোমার ঠান্ডা হাতখান আমার কপালে রাহো, এমনেই জ্বর সাইরা যাইব। এতদিন বাপ ভাইয়েগো ডরে কত কষ্ট কইরা পলাইয়া তোমার কাছে গেছি। আর এহন তারাই তোমারে আমার কাছে পাডাইছে। আইজ আর কোনো ডর নাই। ভাবিরে ডাইকা এই সময়টারে এমনে নষ্ট করতে চাও?"



পর্ব ৯
সামাজিক রোমান্টিক প্রেমের গল্প  "নাইওরি"  ।  @মিঃ বুদ্ধিমান গাধা
সপ্তাহখানেক বাদেই অনুষ্ঠান করে জেসমিনকে শ্বশুরবাড়ি পাঠালেন জয়নাল মির্জা। এরকম কোনো সুযোগ আসবে তা তিনি কল্পনাও করেননি। হারুন ব্যাপারী বুদ্ধিমান লোক হলেও ছেলের প্রতি ভালোবাসায় অন্ধ। নাহলে কেউ এমন প্রস্তাব দেয়! সালিশে তার ছেলের কী বা শাস্তি হতো! এইটুকু তিনি মেনে নিতে পারলেন না! শত্রুর সাথে আত্মীয়তা বড় কঠিন জিনিস। ছেলেকে বাঁচানোর জন্য তিনি এই কঠিন পথ বেছে নিলেন। অবশ্য একমাত্র ছেলের প্রতি অন্ধ ভালোবাসা থাকা অস্বাভাবিক না।
তবে এই আত্মীয়তা হলে হারুণ ব্যাপারী ছাড় দিতে বাধ্য। এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি জয়নাল মির্জা। এক কথাতেই রাজী হলে সেটা অনেকের চোখে পড়তো তাই সে প্রথমে ভেবে দেখার কথা বলেছিল। একটু তো গাইগুই করতেই হয়।
জেসমিন শ্বশুরবাড়ি যেতেই বউ দেখার ঢল নামলো রঞ্জুদের বাড়িতে। সূর্যমনি গ্রামের কোনো বাড়ির মহিলারা বাদ রইলো না। গ্রামের সবচেয়ে শিক্ষিত ছেলে রঞ্জু। এবং সে-ই একমাত্র যে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। তার বউখানা কেমন হলো তা না দেখলে গ্রামবাসীর চলবে কীভাবে! জেসমিনের শাশুড়ি রহিমা বেগম তাদের আপ্যায়নের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। পুতুলের মত একটা বউ আসাতে সে ভীষণ আনন্দিত।
সন্ধ্যার পর থেকেই প্রচন্ড ঝোড়োহাওয়া বইতে লাগলো। দূর আকাশ থেকে ভেসে আসতে লাগলো মেঘমালা। ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বারান্দার দরজার কপাট বারবার বাড়ি খাচ্ছে। রঞ্জু বারান্দার দরজা আটকাতে গেলে জেসমিন বলে,
"আমারে কামিনী ফুলের গাছটা দেহাইলা না যে?"
"এত মানুষ ছিল এতক্ষণ কীভাবে দেখাব বলো? কাল দেখো।"
"আমি এহনই দেখমু।"
রঞ্জু অবাক হয়ে বলল,
"বলে কী মেয়ে! ঝড় শুরু হয়েছে দেখো না? বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।"
"তাতে আমার কী? আমি দেখমু।"
জেসমিন এগিয়ে গেল দরজার কাছে। রঞ্জু তার দুই বাহু ধরে আটকালো। বলল,
"পাগলামি করে না। কাল সকালে দেখো। এখন দরজা জানালা সব আটকে দেয়া উচিৎ। ঝড় শুরু হয়ে গেছে।"
জেসমিন একটু অভিমান করে বলল,
"হুম আমারে দেহাবা ক্যা? কার লাইগা জানি গাছখান লাগাইছো, হেরেই দেহাইয়ো। আমি কেডা!"
ফিরে এসে বিছানার উপর বসলো সে। রঞ্জু দরজা লাগিয়ে এসে তার পাশে বসে মুখটা ধরে বলল,
"তুমি আমার একলা আকাশ
দখিন দ্বারের বাউলা বাতাস
কদম ফুলের ঘ্রাণ,
তুমি আমার জল জোছনা
অন্ধকারের গান।"
কবিতা শুনে জেসমিনের অভিমান নিমিষেই উধাও। সে বলল,
"এই কবিতাটা আমারে চিডিতে দেও নাই তো?"
"এটা তো এই মাত্রই বানালাম।"
জেসমিন মুগ্ধ চোখে জানতে চাইলো,
"তুমি কেমনে এমন কথায় কথায় কবিতা বানাও?"
রঞ্জু হেসে বলল,
"তোমার চাঁদমুখটা দেখলেই আমার কবিতা পায়।"
জেসমিন লজ্জা পেয়ে হাসলো। পরক্ষণেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
"কিন্তু অন্ধকারের আবার গান কেমনে হয়?"
"অন্ধকারের গান অনেক রকম হয়। মন খারাপের হয়, খুশির হয়। আরও কত রকমের!"
"আমি তোমার কেমন অন্ধকারের গান?"
বিছানার পাশেই হারিকেন। রঞ্জু সেটা নিভিয়ে কাছে এসে নিচু গলায় বলল,
"চলো দেখাই তুমি আমার কেমন অন্ধকারের গান।"



পর্ব ১০
সামাজিক রোমান্টিক প্রেমের গল্প  "নাইওরি"  ।  @মিঃ বুদ্ধিমান গাধা
ছোটবেলা থেকেই জেসমিন কিছুটা আলসে। কোহিনূর বানু বকাবকি করে তাকে দিয়ে সব কাজই শিখিয়েছে কিন্তু নিয়মিত করাতে পারেনি। যখন থেকে ভাবিরা এসেছে তখন থেকে তো সে রান্নাঘরের মাটিও মাড়ায়নি। কোহিনূর বানু বলতেন, ঘোরা দেখে খোঁড়া হয়েছে মেয়ে! সেই মেয়েকে কিনা শ্বশুরবাড়ি এসে এখন মসলা বাটতে হচ্ছে! রাতে বাড়িতে কুটুম আসবে। তাই বাহারী রান্নার আয়োজন হচ্ছে। সকালের নাস্তার পরেই কতগুলো করে আদা, রসুন, জিরা, ধনিয়া, হলুদ ও মরিচ বাটতে দিয়েছে শাশুড়ি। জেসমিন যখন এসব বাটছে তখন রান্নাঘরে এলো রঞ্জু। জেসমিনের পাশে বসে বলল,
"তোমার কষ্ট হচ্ছে ফুল?"
জেসমিন হেসে বলল,
"সব কামেই কষ্ট আছে। তয় শাশুড়ি যখন কাম দিছে করতে তো হইবেই। মায় দিলে না কইরা পারা যায়।"
"ইশ আমি বুঝতে পারছি তোমার কষ্টটা! আমাদের বাড়িতে এসব করার কত লোক আছে। মা তোমাকে কেন দিল?"
"তোমাগো বাড়িতে কেউ নাই। হেরা পাশের বাড়িত্যা আহে কাম করতে। আইজ আইতে পারবেনা কেউ। এল্লিগা আমারে দিছে।"
"আমার পড়া শেষ হলে যখন চাকরি করব তখন তোমাকে ঢাকা নিয়ে যাব। তখন আর তোমার এত কষ্ট করা লাগবে না।"
"ঢাকা গেলে বুঝি এইসব করা লাগবে না? আরও বেশি করা লাগবে। সবই একলার করা লাগবে হেকালে।"
"যেসব রান্না করতে মসলা বাটা লাগে তার কোনোটাই আমরা খাব না।"
জেসমিম হেসে বলল,
"বাডা মসল্লা ছাড়া কোনো রান্নাই হয় না। এত কষ্ট বুঝলে বাইট্যা দাও।"
"আচ্ছা বেটেই দেই বরং। তুমি দরজায় পাহাড়া দাও। মা যদি দেখে তোমাকে মসলা বেটে দিচ্ছি, তুফান নামাবে।"
জেসমিন ফিক করে হেসে বলল,
"মায় এহন আইবেনা। তবু পাহাড়া দেই। নাইলে যদি দেইখ্যা হালায় আমারে দজ্জাল বউ কইবে।"
রঞ্জু হেসে দিল। জেসমিন আবার বলল,
"মরিচ বাডা লাগবে না। হাত জ্বলবে। আমি পরে বাডমু। তুমি অন্যগুলান বাডো যেদ্দুর পারো।"
"তোমার হাত জ্বলবেনা?"
"আমি তো আগেও বাডছি। টেকনিক জানি ক্যামনে হাত না লাগাইয়া বাডতে অয়। আর জ্বললেও সহ্য করতে পারমু। তুমি পারবা না।"
জেসমিম উঠে গেল। পাশে বসে দরজায় পাহাড়া দিল। রঞ্জু সত্যিই সত্যিই মসলা বাটতে শুরু করে দিল।
জেসমিন রঞ্জুর বিয়ের পর তিন চার মাস সময় নিলেন হারুন ব্যাপারী। ততদিনে রঞ্জুর ইউনিভার্সিটি খুলে গেছে। সে ঢাকা যাবে, যাওয়ার আগে জেসমিন তার বাপের বাড়িতে নাইওর যাবে। রঞ্জুই দিয়ে আসতে চেয়েছিল যাতে রঞ্জু চলে গেলে তার একা না লাগে। কিন্তু জেসমিন কেঁদেকেটে একাকার করলো। সে জানালো রঞ্জু যতক্ষণ আছে, সে ততক্ষণ কোথাও যাবে না। রঞ্জু ঢাকা যাওয়ার পর সে শ্বশুরের সাথে বাপেরবাড়ি যাবে।
রঞ্জু চলে যাওয়ার পর হারুন ব্যাপারী জেসমিনকে নিয়ে কেশবপুর গেলেন। জেসমিনকে দেখামাত্র তার ভাবিরা খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলো, আমাগো নাইওরী আইছে!
হারুন ব্যাপারীর আতিথেয়তার জন্য বিরাট আয়োজন করা হলো। খাওয়াদাওয়ার পর তারা যখন বাহির বারান্দায় পান নিয়ে বসলনে তখন হারুন ব্যাপারী কথাটা তুললেন,
"চেয়ারম্যান সাহেব কালিসুরির জমিটার কী করবেন? কতগুলা নগদ টাকা দিয়া জমি কিনেছিলাম! আপনি বিচক্ষণ মানুষ, এখন আবার পরম আত্মীয়। আশা করি আপনি ব্যাপারটা ভেবে দেখবেন।"
মুহূর্তের মধ্যেই টনক নড়ল জয়নাল মির্জার। এবার সে বুঝতে পারলো সে যে চিন্তা করে জেসমিন রঞ্জুর বিয়েতে খুশি হয়েছিলেন ঠিক একই চিন্তা করে হারুন ব্যাপারীও বিয়ের প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন। এখন মনে হচ্ছে সে হারুন ব্যাপারীর ফাঁদে পড়েছেন। ইচ্ছে করেই কি সে জেসমিনের পেছনে তার ছেলেকে লেলিয়ে দিয়েছিল? জয়নাল মির্জার মেজাজ তখন সপ্তম আসমানে। সে বলল,
"ব্যাপারী কি এই কারণেই ছেলে বিয়া করাইয়া আত্মীয়তা করছেন?"
হারুন ব্যাপারী হেসে বললেন,
"কী যে বলেন চেয়ারম্যান সাহেব! ছেলে-মেয়ের ভালোবাসার মর্জাদা দেয়ার জন্যই তো এই বিয়ে। ছেলেমেয়ের ভালোবাসা আমাদের ব্যক্তিগত সমস্যার সাথে জড়ানোর কথা চিন্তাও করতে পারিনা।"
"চিন্তা কইরেনও না। ভুলেও না। ছেলে-মেয়েরে আমরা তাদের জায়গায় রাখি আর নিজেগো নিজের জায়গায়। এতেই তারা এবং আমরা ভালো থাকমু। এইসব জমিজিরাতের ভেজালে তাগোরে আইন্যা তাগোর বিপদ ডাকনের দরকার কী?"
চেয়ারম্যানের সুক্ষ্ম হুমকি সাথে করে বাড়ি ফিরলেন হারুন ব্যাপারী। তিনি আজ এটা বুঝে গেলেন যে, জেসমিন রঞ্জুর বিয়ে তার একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। তিনি যেই চিন্তা করে এই বিয়ে দিয়েছিলেন সেটা সম্ভব নয়।


পর্ব ১১
সামাজিক রোমান্টিক প্রেমের গল্প  "নাইওরি"  ।  @মিঃ বুদ্ধিমান গাধা
পটুয়াখালী জজ কোর্টের জাঁদরেল উকিল আলমগীর মৃধা। জনশ্রুতি আছে ফাঁসির আসামিকেও নির্দোষ প্রমাণ করে মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরত নিয়ে এসেছেন তিনি। হারুন ব্যাপারী তার শরণাপন্ন হয়ে মামলা করেছেন জয়নাল মির্জার নামে। তিনি তার জমি পুনরুদ্ধারের জন্য আর্জি দাখিলের পর জয়নাল মির্জার নামে একটি সমন জারি হলো।
সমনপত্র গ্রহন করে কাচারি ঘরে বসে আছেন জয়নাল মির্জা। জালাল বাড়ি নেই। জব্বার আছে সাথে। সে বলল,
"দেখলেন তো আব্বা। আমি কইছিলাম হারুন ব্যাপারীর মতলব ভালো না। আমি হেরে উকিলের কাছে যাইতে দেখছি হেই কতাখানও কইছিলাম। আমনে তো আমার কতা আমলেই লন নাই।"
"কিন্তু জব্বার তুমি হেরে উকিলের কাছে যাইতে দ্যাখছো আরও ৪/৫ মাস আগে। হেকালে মামলা না কইরা এহন করলো ক্যা কও দেহি?"
"হেইয়া আমি ক্যামনে কমু?"
"এই ঘিলু লইয়া রাজনীতি করবা?"
জব্বার মুখ কুচকে ফেলল। পান থেকে চুন খসলেই বাবা তাকে এই খোটাখানা দেয়। যা তার একেবারেই অপছন্দ। জয়নাল মির্জা পানের পিক ফেলে বললেন,
"হারুন ব্যাপারী তহন মামলা করনের লাইগা যায় নাই। হে গেছে তথ্য জোগাড় করতে। মামলা করার প্রস্তুতি নিতেছিল। মাঝখান দিয়া রঞ্জু জেসমিনের ঘটনা আসায় সে ভাবছিল আত্মীয়তা কইরা ঝামেলা মিটাইবে। এইজন্যে এতদিন থাইমা আছিল। কিন্তু এহন যহন দ্যাখলো আত্মীয়তা কামে লাগান যাইতেয়াছেনা, অমনে যাইয়া মামলা দিল।"
"আব্বা আমনে কি আগেইত্যাই জানতেন হে মামলা দেবে?"
"জানতাম। কইতে পারো আমি অপেক্ষাই করতেয়াছিলাম। কারণ সে মামলা না দিলে আমি আমার চাল ডা দিতে পারতেয়াছিলাম না।"
"তহেলে জেসমিনরে ওইবাড়ি বিয়া দেলেন ক্যা?"
"ভাবছিলাম আত্মীয়তা কইরা ঝামেলা মিটামু, ব্যাপারীও যে একই চিন্তা করছে হেইয়া তো আমি বোজতে পারিনাই।"
"আব্বা অরা যদি জেসমিনরে অত্যাচার করে?"
"মাইয়া আমার ধানি মরিচ। অরে কেউ অত্যাচার করতে পারবে না। রঞ্জু জেসমিন আশা করি নিজেগো সামলাইয়া লইতে পারবে। রঞ্জুর মত জামাই লাখে একটা, আশেপাশের চাইর গেরামেও এমন শিক্ষিত পোলা নাই এই কথা সত্য। হেরপরেও সমেস্যা অইলে বিবাহ ভাঙতে কতক্ষণ? জেসমিনরে শহরে নিয়া আরও ভালো আরও শিক্ষিত পোলার লগে বিবাহ দিমু। এই বয়সী পোলাপানের প্রেম ভাঙা মুশকিল, আবেগ বেশি। কিন্তু বিবাহ হইলেই আবেগটা কইম্যা যায়। বিবাহ ভাঙা কোনো বিষয় না। চুলদাড়ি তো বাতাসে পাকে নাই বাজান।"
আলমগীর মৃধার চেম্বারে বসে আছেন জয়নাল মির্জা। তিনি গোপনীয়তা চান। চেম্বারের সকলকে বের করে দিলেন আলমগীর মৃধা। জয়নাল মির্জা বললেন,
"হারুন ব্যাপারী কত দিছে? আমি তার চেয়ে বেশি দিমু। মামলায় আমারে জিতাইয়া দিবেন।"
আলমগীর মৃধা হেসে বললেন,
"হারুন ব্যাপারী কত দিছে জাইন্যা আমনে কী করবেন? আমনে ৫ হাজার দেবেন। আমি কেস এমনভাবে সাজামু যাতে আমি হারি, আমনের উকিল জেতে। ব্যাপারডা বোজ্জেন?"
টাকার অংক শুনে জয়নাল মির্জার মেজাজ বিগড়ে গেছে। বিরক্তমুখে সে বলল,
"উকিলসাব আমনের কি মাতা আউলাইয়া গ্যাছে? ৫ হাজার টাহা কি ভাইস্যা আহে?"
"টাহা ক্যামনে আইবে হেইডা আমনের বিষয়। না দেতারলে বাড়ি যান। এ কেস আমনে এমনেও হারবেন। সমন পাইয়াও কোর্টে আহেন না। ওদিকে বাদীপক্ষ নিয়মিত কোর্টে আহে। তথ্য প্রমাণ সব আমনের বিপক্ষে নেওয়া আমার দুই মিনিটের কাম। আমনের দারে যে একখান জাল দলিল আছে হেইয়া কোর্টে পেশ করলে আমনের উল্টা জেল হবে। আমনের বাঁচার একমাত্র উপায় আমার ইচ্ছাকৃত হারা। কেস হারলে হেইডা আমার রেপুটেশনের ব্যাপার। ৫ হাজার না হইলে পোষায় না। "
জয়নাল মির্জা আর কথা বাড়ালো না। এই সামান্য কাজে ৫ হাজার টাকা খরচ করার কোনো মানেই হয় না। এরচেয়ে সহজ সমাধান তার জানা আছে।
রঞ্জু ক্লাস করে হলে ফিরতেই জেসমিনের চিঠি পেল। রুম পর্যন্ত যাওয়ার ধৈর্য নেই। হলের সামনেই মাঠে বসে চিঠি খুলল।
প্রিয় রঞ্জুসাহেব,
কেমন আছো? আশা করি আল্লাহর রহমতে তুমি ভালো আছো। আমিও ভালো আছি।
পর সমাচার এই যে, আমি এখনো আমাদের বাড়িতেই আছি। বাবা বলতেছেন, তোমাদের বাড়িতে একা গিয়ে কী করব, তুমি আসলে যেন যাই। মাঝে আমার আব্বাকে না জানিয়ে একদিন তোমাদের বাড়ি গেছিলাম। বাবা মায়ের সাথে দেখা করে আসছি। আমি যাওয়াতে তারা খুব খুশি হইছিলেন। কামিনী ফুলের গাছটার কাছেও গেছিলাম। ওই গাছে এখন আর ফুল ফুটে না। আমি জিগাইলাম, কী গো কামিনী ফুল দেও না ক্যা? কামিনী কইলো, তোমরা নাই তাই ফুল দেইনা। তোমরা আসো, ভালোবাসায় ভরায়া রাখো এই ঘরখান। তোমাদের ভালোবাসার সুবাস আবার যখন পাব তখনই ফুল দিব।
এক মাস হইয়া গেল তোমারে দেখি না। আর কতদিন না দেখে থাকতে হবে? তুমি কবে ফিরবা? তোমার ওই পাষাণ মন কি কাঁদে না তোমার ফুলের জন্য? পড়াশোনা বাদ দিয়া চইলা আসো। নাইলে আমারে ঢাকা নিয়া যাও। তোমারে ছাড়া একটা দিনও থাকতে পারমু না আর। বাড়ি আসো। আমার নাইওর আর শেষ হয় না।
ইতি তোমার ফুল।



পর্ব ১২
সামাজিক রোমান্টিক প্রেমের গল্প  "নাইওরি"  ।  @মিঃ বুদ্ধিমান গাধা
হারুন ব্যাপারী আসরের নামাজ পড়ার জন্য পুকুর থেকে ওযু করে এলেন। এসে দেখেন ধুনারি (লেপ তোষক বানানোর কারিগর) এসে উঠানে বসে আছে। তিনিই ডেকেছেন নতুন লেপ বানানোর জন্য। পুরোনো লেপগুলো অল্প দিনেই ভারী হয়ে গেছে। গায়ে দিতে কষ্ট হয়। তুলা ভালো পড়েনি। তাকে দেখেই হারুন ব্যাপারী বললেন,
"কি হে ধুনারী, তোমাকে বলছিলাম সকালে আসতে। এটা একটা আসার সময় হইল?"
"বেইন্যাবেলায় ম্যালা কাম আছিল ব্যাপরীসাব। মাফ করবেন।"
"দাঁড়াও তোমার চাচীরে ডেকে দেই। সে যেমন লেপ চায় তেমন করেই বানাইয়া দিও। খরচ বেশি পড়লে দাম বেশি নিবা। জিনিস যেন ভালো হয়।"
"জিনিস নিয়া আমনে কোনো চিন্তা কইরেন না সাব। খুব ভালো কইরা বানাইয়া দিমু।"
হারুন ব্যাপারী ভেতরে ঢুকতেই তার স্ত্রী রোকেয়া বেগম এসে বললেন,
"আব্দুর রহমান আসছে। আপনের সাথে দেখা করতে চায়। বললো খুব জরুরি।"
"নামাজটা পড়ে যাইতেছি। ধুনারী আসছে উঠানে বসা। যাও তারে মাপঝোপ সব বুঝাইয়া দাও।"
"আচ্ছা।"
হারুন ব্যাপারী নামাজটা সেড়ে কাচারি ঘরে গেলেন। আব্দুর রহমান তার মাছের আড়তের এক কর্মচারী। খুব বিশ্বস্ত লোক। তাকে দেখামাত্র উঠে দাঁড়ালো, চোখেমুখে আতঙ্ক। তিনি বললেন,
"বসো আব্দুর রহমান। আমি তো একটু পরেই আড়তে যাইতাম। কী এমন জরুরি খবর যে এতদূর থেকে বাড়ি আসলা?"
"সর্বনাশ অইয়া গেছে চাচা।"
হারুন ব্যাপারী ভ্রু কুঁচকে বলল,
"কী সর্বনাশ? সরাসরি বলো।"
"উকিলসাব খুন অইছে।"
চমকে উঠলেন হারুন ব্যাপারী। নিজের অজান্তেই তার মুখ থেকে বের হলো,
"আলমগীর মৃধা খুন হয়েছে?"
"জি চাচা। রাইতের অন্ধকারে গলা কাইটা হ্যার বাড়ির রাস্তায় ফালাইয়া রাখছে। আমনেরে কইছিলাম জয়নাল মির্জা দরকারে খুনও করতে পারে। এর আগেও হে এরহম অনেক কাম করছে।"
হারুন ব্যাপারী একটুও সময় নষ্ট না করে তৎক্ষনাৎ পটুয়াখালী রওনা দিলেন।
জেসমিন দুপুরবেলা পুকুর থেকে গোসল করে এসে চুল ঝারছিল। তখন মতি এলো রঞ্জুর চিঠি নিয়ে। রঞ্জুকে চিঠি পাঠানোর এক দিন পর থেকেই নিয়মিত মতিকে পোস্ট অফিসে পাঠায় সে। চিঠি না আসা পর্যন্ত পাঠাতে থাকে। চিঠিটা হাতে নিয়ে জেসমিন সোজা নিজের ঘরে ঢুকলো। দরজা লাগিয়ে বিছানার উপর আয়েশ করে পা ঝুলিয়ে বসে চিঠি খুলে পড়তে শুরু করলো,
তুমি নেই সঙ্গে সখি
তুমি নেই চোখেরও সমীপে,
আছো তুমি অঙ্গে সখি
আছো পরশও প্রতাপে।
যে অঙ্গসুধা এনেছি ভরে হৃদয় কোঠর
ফুরাবেনা গেলে সহস্র কোটি বছর
তুমি নেই বক্ষে সখি
তুমি নেই কক্ষে,
আছো তুমি রোমন্থনে
আছো স্মৃতির দংশনে।
প্রিয় জেসমিন,
তোমার চিঠি পেয়েছি। আশা করি তুমিও ভালোই আছো। গত সপ্তাহে বাবার চিঠি পেয়েছিলাম। তিনি জানিয়েছেন যে তুমি আমাদের বাড়ি গিয়েছো। তুমি যাওয়াতে তারা দুজনেই খুব খুশি হয়েছেন।
তোমার কামিনী গাছ দেখি ভালোই কথা শিখেছে। এরপর গেলে তাকে বলো, খুব দ্রুতই তার কাছে আমাদের ভালোবাসার সুবাস পৌঁছাবে।
আর শোনো মেয়ে, কামিনী ফুল শীতকালে ফোটে না। এটা বর্ষার ফুল। বর্ষা আসলেই আবার ফুটবে তুমি আমি থাকি বা না থাকি।
জেসমিম আর কটা দিন একটু কষ্ট করো। আমি এখন বাড়ি গেলে এই একমাস আমার ঢাকা থাকা বৃথা। কারণ আমার পরীক্ষা শুরু হয়েছে। পরীক্ষাগুলো দিয়ে চলে আসব। এরপর থেকে আর ক্লাস করব না শুধু পরীক্ষার সময় এসে পরীক্ষা দেব। তোমাকে ছেড়ে থাকাটা আমার জন্যে কতটা কষ্টের আশা করি বুঝবে। একটু ধৈর্য ধরো আমার ফুল। খুব শীঘ্রই তোমার নাইওর শেষ হবে।
ভালোবাসা নিও।
ইতি তোমার রঞ্জু।
আলমগীর মৃধার মৃত্যুর আগেই মামলার শুনানির দিন ধার্য হয়েছিল। হারুন ব্যাপারী আলমগীর মৃধার সহকারীর কাছ থেকে সকল তথ্য প্রমাণ জোগাড় করে শুনানির দিনে আদালতে উপস্থিত হন। বাদী পক্ষের উকিল জীবিত না থাকায় আদালতে উপস্থিত হতে পারেন নি। কিন্তু তার রেখে যাওয়া সকল তথ্য প্রমাণ আদালতে পেশ করা হয়েছে। বিবাদী পক্ষ সমনপত্র গ্রহন করেও আদালতে উপস্থিত না হওয়াতে সকল তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে কালিসুরির জমির দখল হারুন ব্যাপারীকে হস্তান্তর করেছে আদালত। উক্ত জমিটি এতদিন অন্যায় ভাবে ভোগদখলের জন্য ক্ষতিপূরণ বাবদ জয়নাল মির্জাকে জরিমানা করা হলে হারুন ব্যাপারী জানালো সে ক্ষতিপূরণ চায় না। জমি ফেরত পেলেই সে খুশি। হারুন ব্যাপারী ভীষণ আনন্দিত। অবশেষে তার স্বপ্নের জমিখানা তার হলো। জয়নাল মির্জাকে কোনো উচ্চবাচ্য করতে দেখা গেল না। সে বিনাবাক্যে জমির দখল ছেড়ে দিল।



পর্ব ১৩
সামাজিক রোমান্টিক প্রেমের গল্প  "নাইওরি"  ।  @মিঃ বুদ্ধিমান গাধা
পুকুরে জাল ফেলে বড় বড় মাছ ধরা হয়েছে। বড় কাতল ও বোয়াল ধরা পড়েছে জালে। খাসিও জবাই করা হয়েছে। এতদিন বাদে জামাই আসছে বলে কথা। লোক পাঠিয়ে গৌরনদীর রসমালাই ও দই আনালেন জয়নাল মির্জা। আয়োজনের কোনো কমতি রাখলেন না।
জেসমিনও আজ ভীষণ খুশি। এতদিন বাদে রঞ্জু আসছে। গতকাল সূর্যমনি এসেছে। আজ কেশবপুর আসবে জেসমিনকে নিতে। কিছুদিন আগে সে ঢাকা থেকে একটা ঢাকাই জামদানি পাঠিয়েছিল। সেটা আজ পরেছে জেসমিন। শাড়িটা পরে রঞ্জুর দেয়া শেষ চিঠি টা ভাঁজ করে আঁচলে বেঁধে নিল সে। প্রতিদিন গোসল করতে যাওয়ার আগে চিঠিটা আঁচল থেকে খুলে ঘরে রেখে যায়। আবার গোসল করে ধোয়া শাড়ি পরে সেই আঁচলে বেঁধে নেয়। এই চিঠির কবিতাটা তার এত বেশি পছন্দের যে যখন তখন আঁচল থেকে খুলে চিঠিটা পড়ে সে! এ পর্যন্ত কবিতাটা যে কতশত বার পড়েছে তার হিসাব নেই।
জেসমিন ঘর থেকে বের হলো। কাচারি ঘরের পেছনে একটা জবা ফুলের গাছ আছে। সেখান থেকে কিছু ফুল এনে রাখলে হয়। রঞ্জু খুশি হবে। ফুল খুব পছন্দ করে মানুষটা।
জেসমিন ফুল ছিড়ে ছিড়ে আচলে রাখছে। এরই মাঝে শুনতে পেল কাচারি ঘরে তার বাবা এবং ভাইয়েরা রঞ্জুর নাম নিয়ে কিছু বলাবলি করছে। যেহেতু রঞ্জুর নামটা আসছে তাই কৌতূহলবশত সে কাচারি ঘরের পেছনের বারান্দায় জানালার কপাটের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালো। এরপর সে যা শুনলো তাতে তার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে গেল। তার বাবা এবং ভাইয়েরা মিলে আজ রাতে রঞ্জুকে খুন করার পরিকল্পনা করছে! তাও সামান্য একটা জমি হারিয়েছে বলে ছেলেকে মেরে বাবার উপর প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছে! তার বাপ ভাইয়েরা ভয়ংকর তা সে জানতো, তাই বলে এতটা হিংস্র! পালাতে হবে, এই মুহূর্তে এখান থেকে পালাতে হবে। রঞ্জু রওনা দেয়ার আগে শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে রঞ্জুর আসা আটকাতে হবে। জেসমিন দৌড় দিল। দূর্ভাগ্যবশত তাড়াহুড়োয় তার হাতের সাথে জানালার কপাট একটা ধাক্কা খেল। শব্দ শুনে জালাল জব্বার পেছনের বারান্দায় তাকাতেই দেখতে পেল জেসমিনকে। কিছু বুঝতে আর বাকি রইলো না তাদের। জব্বার লাফিয়ে পড়ে দৌড় দিল জেসমিনের পেছন পেছন। কয়েকটা বাড়ি পার হয়েই জেসমিনকে ধরে ফেলল। জেসমিন ক্রোধে গর্জন করতে লাগলো,
"খুনীর বাচ্চা খুনী ছাড় আমারে, ছাড় কইতাছি।"
জব্বার জেসমিনের মুখ চেপে ধরে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলো। জেসমিন কিছুতেই যাবেনা। সে আপ্রাণ চেষ্টা করছে নিজেকে ছাড়ানোর। জব্বার তাকে টেনে হিঁচড়ে বাড়ি নিয়ে যেতে লাগলো। কাচারি ঘরে নিয়ে তবেই মুখটা ছাড়লো। সেখানে জয়নাল মির্জা এবং জালাল বসে ছিল। জব্বার যখন গেছে ধরে আনতে পারবে বলেই তাদের বিশ্বাস ছিল। জেসমিনের মুখটা ছাড়তেই সে চেঁচিয়ে উঠলো,
"আব্বা আমনে নিজের মাইয়ার স্বামীরে খুন করার কথা ক্যামনে চিন্তা করলেন? এতবড় কষাই আমনে?"
জয়নাল মির্জা ঠান্ডা মাথার মানুষ। সহজে বিচলিত হন না। সে শান্ত স্বরে মেয়েকে বললেন,
"অরা আমাগো শত্রু মা। তোমার শ্বশুর অনেক বড় পরিকল্পনা কইরা পোলারে তোমার পিছনে লাগাইছিল। কালিসুরির জমিখান যৌতুক নিতে চাইছিল। আমি তো তহন বুঝতে পারি নাই মা। অগো ফাঁদে পা দিয়া ফালাইছি। আমারে মাফ কইরা দেও।"
"মিথ্যা কতা কইবেন না আব্বা। আমি এগুলান বিশ্বাস করি না।"
"বিশ্বাস করো আর না করো, সত্য বলছি। তুমি তারে ভুইলা যাও। তোমারে আরও ভালো পোলা দেইখা বিয়া দিমু।"
জেসমিনের ক্রোধ পরায়ন চোখ দুটো এবার ভিজে এলো। কাঁদতে কাঁদতেই সে চিৎকার করল,
"আল্লাহর গজব পড়ুক। আমারে ছাড়েন, জমি আমনের নামে লেইখ্যা দেতে কমু রঞ্জুরে।"
জয়নাল মির্জা হুক্কায় টান দিতে দিতে বলল,
"জমি দিয়া কী করমু এহন আর? যে সম্মান আমার গেছে তা কি ফেরত পামু?"
"ওরে জল্লাদ রে!"
জেসমিন এবার উপর দিকে চেয়ে দ্বিগুণ স্বরে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
"আল্লাহ তোমার দুনিয়ায় কোনো বাপ কি এমন অয়?"
জয়নাল মির্জা জালাল জব্বারকে বলল,
"অরে এখন আর বাড়ির ভিতর নেওন যাইবো না। চিল্লাইয়া বাড়ির সবাইরে জানান দেবে। কাচারি ঘরেই আটকাইয়া রাখ। আর হাত-মুখ বাইন্দা রাখ। তেজ বেশি মাইয়ার।"
"আব্বা!"
জেসমিন আর কিছু বলার সুযোগ পেল না৷ জব্বার হাত ধরে রেখেছে, জালাল মুখ বেঁধে ফেলল। তারপর চেয়ারে বসিয়ে দুই হাতলের সাথে দুই হাত বাঁধলো। জেসমিন নুন পড়া জোঁকের মত ছটফট করছে। কিছুতেই নিজেকে ছাড়াতে পারলো না। জয়নাল মির্জা বেরিয়ে গেলেন আগে। জালাল ও জব্বার শেষে দরজায় তালা মেরে বের হলেন। ভারী কাঠের চেয়ারের সাথে এমন শক্ত করে বেঁধেছে যে জেসমিন আর নড়তেও পারলো না। অসহায়ের মত কেঁদে চললো শুধু।
রঞ্জু এলো সন্ধ্যার পর। শ্বশুরের সাথে বসে গল্প করছে। জেসমিনকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না। জিজ্ঞেস করতেও একটু লজ্জা লাগছে। এরই মাঝে জেসমিনের মা খেতে ডাকলো। খেতে বসেও জেসমিনকে দেখতে না পেয়ে অবশেষে জিজ্ঞেস করেই ফেলল,
"আম্মা জেসমিনকে দেখছি না। ও কোথায়?"
কোহিনূর বানু স্বামীর কাছ থেকে যা জেনেছেন তাই বললেন,
"মিনুর বাচ্চা অইবে তো। কি সমেস্যা জানি অইছে। আমাগো এদিকের হাসপাতালে আনছে। খবর পাইয়া জব্বার গেছে, লগে জেসমিনও গেছে। আইয়া পড়বে, তুমি খাও বাবা।"
রঞ্জুর একটু মন খারাপ হয়েছিল, ৩ মাস পর বাড়ি এলো অথচ জেসমিনকে দেখতে পাচ্ছে না! এখন অবশ্য মন খারাপ লাগাটা আর নেই। শাশুড়ির হাতের রান্না বরাবরই রঞ্জুর খুব প্রিয়। সে খুব তৃপ্তি করে কব্জি ডুবিয়ে খেল। খাওয়া বেশি হওয়াতে সে একটু উঠোনে হাঁটতে নামলো। কাচারিঘরের সামনেই হাঁটছিল সে। জালাল পেছন থেকে বলল,
"রঞ্জু ময়নার বিলে মাছ কোপাইতে যাবা নাকি?"
জেসমিন একথা শুনে চমকে উঠলো। রঞ্জু এসে পড়েছে? তখনই রঞ্জুর গলা শোনা গেল,
"আরে ভাইজান দারুণ আইডিয়া! কতদিন মাছ কোপাই না! চলেন যাই। জেসমিন বাড়িতে নাই ভালোও লাগছে না।"
জেসমিনের হৃদয়টা হুঁ হুঁ করে উঠলো। কতদিন পর রঞ্জুর গলার স্বর শুনতে পেল। রঞ্জু তার এত কাছে!
জালাল হাঁক ছেড়ে বলল,
"এ কুদ্দুস ফুলকুচি আর কোচ গুলান লইয়া আয়। জামাইরে নিয়া মাছ ধরতে যামু।"
জেসমিন মরিয়া হয়ে উঠলো রঞ্জুকে বাঁচানোর জন্য। কিন্তু কীভাবে বাঁচাবে তাকে? চেয়ারটা এত ভারী যে সে একটুও নড়াতে পারলো না। মাটির মেঝেতে ঠেসে আছে চেয়ারের পায়াগুলো। আশেপাশে তাকিয়ে জয়নাল মির্জার রেখে যাওয়া হুক্কা টা দেখতে পেল। সেটাকেই পা বাড়িয়ে ছোঁয়ার চেষ্টা করলো। অনেক কষ্টে যখন ছুঁতে পারলো তখন সেটা উলটে দিল যাতে শব্দ হয়। আর শব্দটা রঞ্জুর কানে যায়। যদিও এটা সন্দেহ হওয়ার মত কিছু নয় তবুও একটা চেষ্টা।
শব্দটা শুনে রঞ্জু বলল,
"কাচারি ঘরে তো তালা মারা। তাহলে ভেতরে কীসের শব্দ ভাইজান?"
জালাল বলল,
"বিলোই হানছে মনে হয়। বাদ দেও। চলো মাছ ধরতে যাই।"
হুক্কাটা ধাক্কা খেয়ে দূরে গিয়ে পড়েছে আরেকটা শব্দ করার মত কোন উপায় জেসমিনের রইলো না। পায়ের আওয়াজ দূরে থেকে আরও দূরে যেতে থাকলো। জেসমিন বুঝতে পারলো জালাল ও রঞ্জু চলে যাচ্ছে। শেষ, সব আশা শেষ! জেসমিন অঝোরে কাঁদতে লাগলো। পেটের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
"তোর আসার খবরটা তোর বাপরে দেয়ার জন্য এত উতলা হইয়া বাড়ি আসতে কইছিলাম, তারপরেও কত অপেক্ষা! অথচ তোর বাপ জানতেও পারলো না তোর আসার কথা!"



শেষ পর্ব
সামাজিক রোমান্টিক প্রেমের গল্প  "নাইওরি"  ।  @মিঃ বুদ্ধিমান গাধা
জামাই নিয়ে মাছ ধরতে ময়নার বিলে গিয়ে সেখানেই তাকে খুন করে বিলে ফেলে এলো জালাল জব্বার ও জয়নাল মির্জার লোকেরা। তবে মৃত্যুর আগে রঞ্জু এটা জেনে যেতে পারলো যে তার বাবার ঠিক কোন অপরাধের জন্য তাকে মরতে হচ্ছে। এও জানতে পারলো, কাচারি ঘরে কোনো বিড়াল ছিল না। ছিল হাত-মুখ বাঁধা তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী। তাকেই বাঁচাবার শেষ চেষ্টাসরূপ শব্দটা করেছিল সে। জালাল জব্বার রসিয়ে রসিয়ে বলছিল সেসব কথা!
আহারে জীবন! আরেকটি বার জেসমিনের সাথে দেখা হলো না। শোনা হলো না তার না বলা সেই কথাগুলো! এতগুলো দিন অপেক্ষার কোনো অর্থ রইলো না। কে জানতো মাত্র এক মাসের ব্যবধানে এতকিছু ঘটে যাবে!
সেই রাতেই জেসমিনকে কাচারি ঘর থেকে তার ঘরে আনা হলো। কিন্তু এখানেও তাকে আটকে রাখার নির্দেশ দিলেন জয়নাল মির্জা। জেসমিনের দরজার বাইরে একজনকে পাহাড়ায়ও বসানো হলো।
রঞ্জুর মৃত্যুর খবর পেয়ে জেসমিন মাটিতে শুয়ে পড়ে বলল,
"আমারেও ওই মাটিতে মিশাইয়া দেও তোমরা!"
কিন্তু চিৎকার করার মত শক্তি আর তার অবশিষ্ট নেই। সে শুধু উদ্ভ্রান্তের মত কেঁদে চলেছে। উল্টোপাল্টা প্রলাপ বকছে। কোহিনূর বানু জয়নাল মির্জাকে বললেন,
"আর কত পাপ করবেন? নিজের মাইয়ারেও যে কেউ বিধবা করতে পারে আপনেরে না দ্যাখলে জানতাম না।"
জয়নাল মির্জা মেয়েছেলের কথা গায়ে মাখেন না। সে তার ঘরে গিয়ে শান্তির ঘুম দিল। হারুন ব্যাপারী অতি বাড় বাড়ছিল। এতদিনে তাকে একটা উপযুক্ত জবাব দেয়া গেছে। জয়নাল মির্জার সাথে লাগতে আসলে কী হতে পারে সেটা এবার বুঝবে।
পরদিন দুপুরের খাবার খাওয়াতে জেসমিনের ঘরে ঢুকলেন কোহিনূর বানু। বাইরে পাহাড়াদার। তাই জেসমিন ফিসফিসিয়ে বলল,
"মা আমার পেটে রঞ্জুর বাচ্চা।"
এ কথা শুনে আৎকে উঠলেন কোহিনূর বানু। যে খবরে খুশি হবার কথা সে খবরে আজ সে খুশি হতে পারছে না। তার কষ্ট আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেল।
তিনি কিছুই বলতে পারলেন না। জেসমিন আবার বলল,
"আমি পলাইয়া যামু। আমারে সাহায্য করো মা। অরা বাচ্চাডার কথা জানতে পারলে রাখতে দেবে না।"
"কিন্তু পলাইয়া যাবি কোতায়?"
"শ্বশুরবাড়ি যামু। হেরা জাগা না দিলে একদিকে যামু যাইয়া। কপালে যা আছে তাই হবে। আমি খালি বাচ্চাডারে জন্ম দিতে চাই মা। আমার রঞ্জুর একমাত্র চিহ্ন ও। আমি অরে সারাজীবন আমার লগে রাখতে চাই। তোমার দুইডা পায়ে ধরি আমারে পলাইতে সাহায্য করো।"
কোহিনূর বানু শতভাগ নিশ্চিত বাচ্চার কথা জানাজানি হলে জেসমিন যা বলেছে তাই হবে। তিনি রাতের খাবার খাওয়ানোর ছুঁতোয় জেসমিনের ঘরে ঢুকে হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিলেন কোহিনূর বানু। তারপর ফিসফিস করে বললেন,
"এই টাহা কয়ডা রাখ। কামে লাগবে। আর পাশের বাড়ির আয়নালরে কইয়া ঘরের সিঁধ কাটনের ব্যবস্থা কইর‍্যা রাখছি। রাইত বাড়লে আইয়া কাইট্যা দেবে। বাইর হইয়া যাইছ।"
জেসমিন মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। বলল,
"মাগো সারাটা জনম তোমারে খালি জ্বালাইসি। আমারে মাফ কইরা দিও।"
কোহনূর বানুও চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না। সে মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
"পাগল মাইয়া আমার! যেখানেই থাকোস নিজের যত্ন নিবি, মার দোয়া সবসময় তোর লগেই আছে। অনেক দূরে চইলা যাইস। এই শকুনের দল জানি তোর নাগাল না পায়! এত বড় দুনিয়ার কোনো না কোনো খানে তোর জায়গা নিশ্চয়ই হবে।"
জেসমিন মাঝরাতে পালিয়ে গেল। দৌড়াতে দৌড়াতে যখন শ্বশুরবাড়ি পৌঁছালো তখন ভোর হয়ে গেল। বাড়িতে ঢুকে উঠান পার হয়ে ঘরে ঢোকার সিঁড়িতে উঠলো। তারপর আচমকাই ঘরের ভেতর থেকে রোকেয়া আর হারুন ব্যাপারীর কথা শুনতে পেয়ে থেমে গেল। রোকেয়া বেগম বিলাপ করছিলেন,
"আপনেরে আমি বলছিলাম জয়নাল মির্জার লগে গ্যাঞ্জাম কইরেন না। গ্রামের সবাই মানা করছিল। আপনি শুনেন নাই। কি এক জমি নিয়া পইড়া ছিলেন। কী লাভ হইল জমি পাইয়া? ছেলে তো হারাইলেন। আবার জমির আশায় ছেলে বিয়া করাইলেন ওই কষাইয়ের বাড়িতে। এত লোভ ক্যান আপনের? এখন দেন, আমার ছেলেরে ফেরত দেন।"
হারুন ব্যাপারী বললেন,
"কাইন্দ না রঞ্জুর মা। আমাদের ছেলেকে যে এইভাবে হত্যা করেছে তাকে আমি ছাড়ব না। জেসমিন একদিন না একদিন এই বাড়ি আসবে। তার বাপের চোখে ফাঁকি দিয়ে হলেও আসবে। সেইদিন জেসমিনকে টুকরা টুকরা করে তার বাপের কাছে উপহার পাঠাব।"
জেসমিন কেঁপে উঠলো। রোকেয়া বেগম বললেন,
"আপনাদের খুনাখুনি তো চলতেই থাকবে...
জেসমিন বাকি কথা আর শুনলো না। শোনার দরকারও নেই। চুপিচুপি কয়েক পা পেছনে এসে উলটো ঘুরে দৌড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। রাস্তায় উঠেও দৌড়াতে লাগলো। দৌড়াতে দৌড়াতে কোন দিকে গেল সে জানেও না। একসময় ভোর হয়ে এলো। এবার দৌড় থামিয়ে সে মাথায় ঘোমটা তুলে হাঁটতে লাগলো। অনেকক্ষণ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে এক নদীর ঘাটে এসে পৌঁছালো। ততক্ষণে সূর্য মাথার উপরে। বড্ড ক্লান্ত লাগছে। একটা নৌকায় অনেক যাত্রী উঠছে। নৌকা কোথায় যাবে সে জানেনা। তবু উঠে পড়লো।
নৌকার এক কোনায় বসে আঁচল দিয়ে ঘাম মুছলো। তখনই হাতে পড়ল আঁচলে বাধা রঞ্জুর চিঠিটা। বাঁধন খুলে চিঠিটা বের করলো জেসমিন। সেখানে লেখা,
তুমি নেই সঙ্গে সখি
তুমি নেই চোখেরও সমীপে,
আছো তুমি অঙ্গে সখি
আছো পরশও প্রতাপে।
যে অঙ্গসুধা এনেছি ভরে হৃদয় কোঠর
ফুরাবেনা গেলে সহস্র কোটি বছর
তুমি নেই বক্ষে সখি
তুমি নেই কক্ষে,
আছো তুমি রোমন্থনে
আছো স্মৃতির দংশনে।
রঞ্জুর হাতের লেখা! লেখাটার উপর হাত বুলিয়ে চিঠিটা ভাঁজ করে আবার আঁচলে বেঁধে রাখলো জেসমিন। নৌকা এ ঘাট ও ঘাট ঘুরে শেষ ঘাটে যখন থামলো তখন সে একটা বাসস্ট্যান্ডে এসে পৌঁছালো। উঠে পড়লো বাসে। বাস কোথায় যাবে তা জানার আগ্রহ তার নেই। সে শুধু দূরে যেতে চায়। এইসব মারামারি খুনোখুনি থেকে অনেক দূরে। যেখানে গেলে সে তার সন্তানকে নিয়ে নিশ্চিন্তে বাঁচতে পারবে।

সমাপ্ত


""""""""""''''''''''''''''''''''''''''''''''''''""

















No comments

Powered by Blogger.